খাদ্য উৎপাদনে পশুর গুরুত্ব

আমাদের আজকের আর্টিকেলটি খাদ্য উৎপাদনে পশুর গুরুত্ব সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট-১ এর অন্তর্ভুক্ত |

খাদ্য উৎপাদনে পশুর গুরুত্ব

দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন ও দেহ গঠনের জন্য আমিষজাতীয় খাদ্যের প্রয়োজন। দুধ ও মাংস আমিষজাতীয় খাদ্য। দুধ ও মাংস আমরা গৃহপালিত পশু থেকে পেয়ে থাকি। তবে, হাঁসমুরগিও আমাদের আমিষসমৃদ্ধ ডিম ও মাংস সরবরাহ করে থাকে।

দুধের সংজ্ঞা

এক বা একাধিক দুগ্ধবতী গাভীর ওলান গ্রন্থির সম্পূর্ণ দোহনের ফলে যে তরল পদার্থ পাওযা যায় এবং যাতে কমপক্ষে ৩.৪% চর্বি এবং চর্বি ছাড়া অন্যান্য খাদ্যোপাদান ও খনিজ পদার্থ কমপক্ষে ৮.২% বিদ্যমান থাকে, তাকে দুধ বলে।

দুধের গুণাগুণ

দুধকে আদর্শ খাদ্য বলা হয়। বাচ্চা প্রসবের পর থেকে ৩-৪ দিন পর্যন্ত উৎপন্ন পশুর দুধকে শালদুধ বা কলস্ট্রাম বলে। এতে খনিজপদার্থ, ভিটামিন-এ ও রোগপ্রতিরোধক অ্যান্টিবডি থাকে। স্বাভাবিক দুধের তুলনায় কলস্ট্রামে আমিষের পরিমাণ ৩-৫ গুণ, চর্বি প্রায় দ্বিগুণ এবং খনিজপদার্থ ও ভিটামিন অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। তবে, বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর সময়ের সাথে কলস্টামের গঠন পরিবর্তিত হয়। এই দুধ পানে বাচ্চার পেটে জমে থাকা মল বের হয়ে যায়। খাবারে রুচি আসে।

মানুষ বা পশুর বাচ্চার শরীর ঠিকমতো বৃদ্ধির জন্য যেসব অতি প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড দরকার সেগুলোসহ দুধের আমিষে সব ধরনের অ্যামাইনো এসিডই আছে। উদ্ভিদ আমিষে লাইসিন, মিথিওনিন ও সিটিনের অভাব রয়েছে বিধায় বাচ্চাদের সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত দুধ পান করানো উচিত। অনুরূপভাবে, দুধের চর্বিতে অতি প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিডসহ (লিনোলিক ও লিনোলেনিক এসিড) অন্যান্য ফ্যাটি এসিডগুলোও আছে। গৃহপালিত পশুর মধ্যে আমাদের দেশে দুধের জন্য গাভী, ছাগল ও মহিষ প্রসিদ্ধ।

এসব পশুর দুধের মধ্যে সামান্য তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও একই প্রজাতির পশুর, এমনকি, বয়সভেদে একই পশুর দুধের গঠনে তারতম্য দেখা যায়। এখানে গাভীর কলস্ট্রাম ও দুধ এবং বিভিন্ন পশুর দুধের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে।

সারণি ৬ : গাভীর কলস্টাম, দুধ এবং বিভিন্ন পশুর দুধে উপস্থিত পুষ্টি উপাদানসমূহের হার

 

খাদ্য উৎপাদনে পশুর গুরুত্ব

 

দুধ উৎপাদনে পশুর গুরুত্ব

স্তন্যপায়ী প্রাণী বাচ্চা প্রসবের পর স্তন গ্রন্থি থেকে দুধ নিঃসরন করে। সাধারণত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উটের দুধ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে, আমাদের দেশে প্রধানত গরু, মহিষ ও ছাগলের দুধই খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

দুধের ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশে দুধ আমদানির একটি প্রতিবেদন এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

সারণি ৭ : বাংলাদেশ কর্তৃক গুড়া দুধ আমদানি (১৯৮৫-৪৮৬ থেকে ১৯৮৯-৮৯০ সাল)

 

খাদ্য উৎপাদনে পশুর গুরুত্ব

 

দুধ উৎপাদনে ছাগলের গুরুত্ব

  • ছাগলের দুধের চর্বি কণা ছোট বলে সহজপাচ্য; বৃদ্ধ ও রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী।
  • ছাগল বাংলাদেশে গরীবের গাভী হিসেবে পরিচিত। দুঃস্থ মহিলা, বিত্তহীন, ভূমিহীন ও যাদের গাভী কেনার ক্ষমতা নেই  তারা ছাগল পালন করে দুধের প্রয়োজন মেটায় অথবা দুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে।
  • ছাগলের দুধের উৎপাদন খরচ কম হয়।

উৎপাদনে মহিষের গুরুত্ব

  • মহিষের দুধে গরুর দুধ অপেক্ষা পানির পরিমাণ কম এবং চর্বির পরিমাণ বেশি। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য মহিষের দুধ থেকে ঘি, দধি, মাখন, পনির প্রভৃতি বিশেষভাবে প্রস্তুত হয়।
  • ভারত ব্যতীত বিশ্বের অন্যান্য দেশে মহিষের দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপনন ব্যবস্থার জন্য কোনো স্বীকৃত মানদন্ড নেই।

মাংস উৎপাদনে পশুর গুরুত্ব

প্রাচীনকাল থেকেই পশুর মাংস মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আদিম গুহাবাসী মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেসব খাদ্য গ্রহণ করত তার মধ্যে মাংসই প্রধান ছিল। তারা অবশ্য ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মাংস ভক্ষন করত। এ যুগে ক্ষুধা নিবৃত্তি ছাড়াও মাংসের পুষ্টিগুণের জন্য খাদ্য হিসেবে এটি গ্রহণ করা হয়। এটি উৎকৃষ্ট আমিষ ও খেতে সুস্বাদু যা দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন ও দেহ গঠনে সহায়তা করে। মাংস থেকে নানাবিধ মজাদার খাবার, যেমন- চপ, কাটলেট, কাবাব, রোস্ট প্রভৃতি তৈরি করা যায়।

মাংসের গুণাবলী

  • টাটকা মাংসে ১৫-২০% আমিষ থাকে।
  • এতে অতি প্রয়োজনীয় সকল অ্যামাইনো এসিড বিদ্যমান।
  • মাংসের সঙ্গে লাগানো চর্বি শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।

সারণি ৮ : বিভিন্ন প্রজাতির পশুর মাংস ও দুধে পুষ্টির পরিমাণ

 

খাদ্য উৎপাদনে পশুর গুরুত্ব

 

মাংস উৎপাদনে ছাগলের গুরুত্ব

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু। ছাগলের মাংসকে ইংরেজিতে চিভন ( Cheavon) বলে। এদেশে ছাগলের মাংসের চাহিদা খুব বেশি। সারাদেশে প্রতিদিন বহু ছাগল জবাই হয়। ছাগলের মাংস বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ছাগলের মাংসের বেশ চাহিদা রয়েছে। ছাগলের মাংস সংরক্ষিত অবস্থায় বিদেশে অনায়াসে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে আমাদের দেশে এ ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধির হার কম।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দিয়ে এদেশের মাংসের চাহিদা মেটানো খুব সহজ কারণ এরা প্রতিবারে ২-৪টি বাচ্চা দিতে সক্ষম। কম ব্যয়ে উত্তম মাংস পেতে হলে ছাগল পালন করা উচিত। এদের পালনে খরচ কম অথচ লাভ বেশি। আমিষের চাহিদা মেটাতে ছাগলের গুরুত্ব অপরিসীম।

মাংস উৎপাদনে গরুর গুরুত্ব

পৃথিবীর বহু দেশে গোমাংস প্রিয় খাদ্য। গরুর মাংসকে ইংরেজিতে বিফ (Beef) বলে। গোমাংস থেকে চপ, কাবাব, কাটলেট, বার্গার এবং আরও নানা ধরনের খাবার তৈরি হয়। মুসলিম দেশগুলোতে যে কোনো ভোজে গোমাংসের ভূনা আলাদা মর্যাদা লাভ করেছে। আজকাল শুকনো ও দুর্বল ষাঁড়কে ৩-৪ মাস ভালো খাদ্য খাইয়ে মোটাতাজা করা হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল জনবহুল দেশে এ কর্মকান্ড আমিষ ঘাটতি পূরণে বিরাট ভূমিকা পালন করবে।

মাংস উৎপাদনে ভেড়ার গুরুত্ব

ভেড়ার মাংসও সুস্বাদু। ভেড়ার মাংসকে ইংরেজিতে মাটন (Mutton) বলে। ভেড়া ছাগলের তুলনায় নিম্নমানের খাদ্য খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে। কম খরচে সহজে ভেড়া পালন করা যায়। মাংসের চাহিদা মেটাতে ভেড়ার ভূমিকাও কম নয়। ভেড়া পালন করলে মাংসের জন্য ছাগলের উপর চাপ কমবে। তাই আমিষের চাহিদা পূরণ করতে ভেড়ার গুরুত্বও কম নয়।

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

মাংস উৎপাদনে মহিষের গুরুত্ব

অন্যান্য গৃহপালিত পশু অপেক্ষা মহিষ বড় আকারের প্রাণী। সেজন্য পশুপ্রতি মাংস উৎপাদনে মহিষের স্থান সবার উপরে। মহিষের মাংসকে ইংরেজিতে বুফেন (Buffen) বলে। ২৪ মাসের কম বয়সের মহিষের মাংস গরুর মাংসের মতোই সুস্বাদু। এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠির আমিষের চাহিদা মেটাতে তাই গরুর পাশাপাশি মহিষের মাংস উৎপাদন ও ব্যবহারে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বর্তমানে আমাদের দেশের শতকরা ৮০% লোক আমিষের অভাবজনিত রোগে ভূগছে। অন্যান্য গৃহপালিত পশুর সাথে মহিষের সংখ্যা বাড়িয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মাংস খাওয়ার প্রচলন করতে পারলে এদেশের আমিষের চাহিদা পূরণে সাহায্য হবে।

মহিষ পালনে বিশেষ কিছু সুবিধাও আছে৷ যেমন- প্রতিকূল পরিবেশে এরা বেঁচে থাকতে পারে, এদের রোগবালাই কম হয়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, গরুর তুলনায় নিম্নমানের খাদ্য খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে। উন্নত খাদ্য প্রদান করলে অনুকূল পরিবেশে ৮-৯ মাস বয়সের মহিষের বাছুর দৈনিক এক কেজি পরিমাণ দৈহিক ওজন বৃদ্ধি করতে পারে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment