Site icon Livestock Gurukul [ লাইভস্টক গুরুকুল ] GOLN

গাভীর খাদ্য

গাভীর খাদ্য

আমাদের আজকের আর্টিকেলটি গাভীর খাদ্য সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৫ এর অন্তর্ভুক্ত |

গাভীর খাদ্য

গাভীর খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা

গাভীর শারীরিক বৃদ্ধি ও কোষকলার বিকাশ, তাপ ও শক্তি উৎপাদন, দেহ সংরক্ষণ ও কোষকলার ক্ষয়পূরণ, দুধ ও মাংস উৎপাদন, প্রজননে সক্ষমতা অর্জন, গর্ভস্থ বাচ্চার বিকাশ সাধন প্রভৃতি কাজের জন্য উপযুক্ত খাদ্যের প্রয়োজন। ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য খাদ্যদ্রব্যের চাহিদায় বেশ তারতম্য হয়। যেমন- দেহের ক্ষয়পূরণ, দেহকে কর্মক্ষম রাখা প্রভৃতি কাজে যে পরিমাণ পুষ্টির প্রয়োজন হয় দুধ, মাংস প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য সেগুলো ছাড়াও অতিরিক্ত পুষ্টির প্রয়োজন পড়ে।

খাদ্যদ্রব্যের বিভিন্ন উপাদানসমূহ সম্পর্কে ইতোপূর্বে বাছুর পালন ইউনিটে বলা হয়েছে; এই উপাদানগুলো গাভীর জন্যও প্রয়োজন। তবে দুধ উৎপাদন গাভীর জন্য একটি বিশেষ ধরনের কাজ বলে এজন্য গাভীর খাদ্য যোগানের ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। খাদ্যদ্রব্যের কোনো উপাদানের অভাব হলে গাভীর দেহে তার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। শক্তির জন্য শর্করা, দেহের ক্ষয়পূরণ ও উৎপাদনের জন্য আমিষ, স্নেহ, খণিজ, ভিটামিন এবং সমুদয় জৈব রাসায়নিক কর্মকান্ডের জন্য প্রচুর বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয়।

সকল অত্যাবশ্যক খাদ্যদ্রব্যকে পরিপাচ্য পুষ্টি (digestible nutrients) নামে উল্লেখ করা হলেও পরিপাচ্য পুষ্টি বলতে শর্করা, স্নেহ ও আমিষকেই বোঝানো হয়। বিভিন্ন খাদ্যের পরিপাচ্য পুষ্টির মানে পার্থক্য থাকে। শর্করা যে শক্তি দেয় আমিষও সে পরিমাণ শক্তি যোগায়। কিন্তু স্নেহ পদার্থ, শর্করা ও আমিষের চেয়ে ২.২৫ গুণ বেশি শক্তি দেয়। আমিষ শুধু শক্তিই দেয় না, শরীর গঠনের মৌলিক জৈব উপাদান তথা অ্যামাইনো অ্যাসিডও দিয়ে থাকে।

খণিজপদার্থ ও ভিটামিন কোনো শক্তি দেয় না, কিন্তু এগুলোর উপস্থিতি ব্যতিরেকে শরীরের কর্মচাঞ্চল্য বা উৎপাদন কোনো কিছুই ঠিকমতো হয় না। এগুলো শরীরে খুব সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হলেও অত্যাবশ্যক; অতএব এসব খাদ্যের শ্রেণী ও প্রকৃতি বিবেচনা করে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সমন্বয়ে গাভীর সার্বিক প্রয়োজনে সুষম খাদ্য (balanced diet) প্রস্তুত করতে হয়।

 

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

সুষম খাদ্য (Balanced diet)

যেসব খাদ্য মিশ্রণে পশুর দৈহিক প্রয়োজন মিটানোর জন্য উপযুক্ত পরিমাণ ও অনুপাতে সব রকম পুষ্টি উপাদান থাকে সেগুলোকে সুষম খাদ্য বলে। প্রতিটি গাভীর জন্য সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। কারণ খাদ্যে বিভিন্ন উপাদানের সুষমতার অভাব হলে গাভী তার প্রয়োজন অনুযায়ী পুষ্টি উপাদান পায় না । ফলে দেহগঠন ও উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। সুষম খাদ্য নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করবে-

গাভীর খাদ্যদ্রব্য সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন- আঁশযুক্ত খাদ্য (roughages), দানাদার খাদ্য (concentrates) ও ফিড অ্যাডিটিভস্ (feed additives) আঁশযুক্ত খাদ্যের মধ্যে খড়বিচালি, কাঁচা ঘাস, লতাপাতা, সাইলেজ (silage) ইত্যাদিই প্রধান। দানাদার খাদ্যের মধ্যে বিভিন্ন শস্যদানা, গমের ভুশি, চালের কুড়া, খৈল ইত্যাদিই প্রধান। ফিড অ্যাডিটিভস্-এর মধ্যে ঝিনুকচূর্ণ, বিভিন্ন ভিটামিন ও খণিজপদার্থ প্রভৃতি রয়েছে। এসব পশু খাদ্য প্রয়োজনমতো সংগ্রহ করে গাভীকে পরিবেশন করতে হবে। পশুকে যে পরিমাণ খাদ্য পরিবেশন করতে হয় তা এক ধরনের থাম্ব রুল (thumb rule) নিয়মে নিরূপন করা যেতে পারে। যেমন-

পশু পুষ্টি বিদ্যায় প্রতি ৪৫.৫ কেজি (১০০ পাউন্ড) দৈহিক ওজনের ভিত্তিতে খাদ্যতালিকা বা রসদ বরাদ্দের নীতিও চালু আছে। প্রতি ৪৫.৫ কেজি (১০০ পাউন্ড) দৈহিক ওজনের জন্য ০.৯ কেজি (২ পাউন্ড) আঁশযুক্ত খাদ্য বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। এই নীতি অনুযায়ী প্রথম ২.৪ কেজির জন্য ২.৪ কেজি ও পরবর্তী প্রতি ০.৯ কেজি উৎপাদনের জন্য ০.২৩ কেজি দানাদার খাদ্য বরাদ্দ করে রসদ যোগান দিতে হবে ।

খাদ্য তৈরি ও হিসাব পদ্ধতি

গাভীর খাদ্য তৈরিতে নিলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। যথা-

এখন দেখা যাক, ৪৫.৫ কেজি ভুট্টা ঘাসে কী পরিমাণ ডি.পি. ও টি.ডি.এন. আছে। খাদ্য উপাদানসমূহের তালিকায় দেখা যায়- ৪৫.৫ কেজি ভূট্টায় ১.২% ডি.পি. ও ১৬.৩% টি.ডি.এন. থাকে । সুতরাং যদি ঐ গাভীকে ৪৫.৫ কেজি ভুট্টা ঘাস খাওয়ানো যায় তাহলে প্রয়োজনের তুলনায় সে প্রায় দ্বিগুণ ডি.পি. ও টি.ডি.এন. পেয়ে থাকে । অর্থাৎ তাকে ২২.৭৫ কেজি ঘাস খাওয়ালে তার দৈহিক চাহিদা প্রায় মিটে যায়। আর ঐ গাভী যদি দৈনিক ৪.৫৫ কেজি করে দুধ (৪% বাটার ফ্যাটসমৃদ্ধ দেয় তাহলে তাকে অতিরিক্ত খাদ্য দিতে হবে।

তালিকা অনুসারে ৪.৫৫ কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য ১৮৬ গ্রাম ডি.পি. ও ১.৪১ কেজি টি.ডি.এন.-এর প্রয়োজন। তালিকা দেখে আমরা বলতে পারি যে, প্রতি কেজি ভুট্টা ঘাসে ৬ গ্রাম ডি.পি. এবং ৭২.৭৩ গ্রাম টি.ডি.এন. থাকে । কাজেই ১৫.৯ কেজি দুধ দেয় (৪% বাটার ফ্যাটসমৃদ্ধ) এমন গাভীকে (২২.৭৫+১৫.৯) = ৩৮.৬৫ কেজি ভুট্টা ঘাস খাওয়ালে তার খাদ্য চাহিদা পূরণ হয়। কার্যক্ষেত্রে একটি গাভীর জন্য এই পরিমাণ ভুট্টা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। তাই কিছু ঘাস, খড় ও দানাদার খাদ্য দিয়ে তার পুষ্টি চাহিদা মেটানো যেতে পারে।

দানাদার খাদ্যের একটি মিশ্রণ তৈরি করা হলে এতে খৈল ২৫%, গমের ভুশি ২৫%, খেসারির ডাল ২৫%, ভুট্টার গুঁড়ো ২৫% দেয়া যেতে পারে। এ মিশ্রণের প্রতি ০.৪৫৫ কেজিতে প্রায় ১৪% ডি.পি. ও ৭০% টি.ডি.এন. পাওয়া যেতে পারে। যে মিশ্রণে ৬.৬৩ কেজি ডি.পি. ও ৩১.৮ কেজি টি.ডি.এন. থাকে সেখান থেকে ২.২৭ কেজি দানাদার মিশ্রণ গাভীকে খাওয়ানো হলে গাভী তার দেহের জন্য ৩১৮ গ্রাম ডি.পি. পাবে। এই পরিমাণ তার মোট চাহিদার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে-

 

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে গাভীটিকে দৈনিক ২২.৭৫ কেজি ভুট্টা ঘাস ও ২.২৭ কেজি দানাদার খাদ্য খাওয়ালে পুষ্টি চাহিদা সঠিকভাবে মেটানো সম্ভব হয়।

গাভীর দানাদার খাদ্য

সারণি ১৯ (ক, খ, গ ও ঘ)-এ গাভীর দানাদার খাদ্যের কয়েকটি সূত্র দেয়া হয়েছে। গাভীর দানাদার খাদ্য তৈরিতে এগুলো থেকে যে কোনো একটি সূত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।

সারণি ১৯ (ক, খ, গ ও ঘ ) : গাভীর দানাদার খাদ্যের সূত্রসমূহ

 

 

গাভীর খাদ্যতালিকা বা রসদ (ration)

গাভীকে দৈনিক অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় যে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য বা খাদ্যসমষ্টি খেতে দেয়া হয়, তাকে খাদ্যতালিকা, রসদ বা রেশন বলে। সারণি ২০-এ প্রায় ১০০ কেজি ওজনের একটি গাভীর জন্য সুষম
খাদ্যতালিকার একটি নমুনা দেখানো হয়েছে।

সারণি ২০ঃ১০০ কেজি ওজনের একটি গাভীর সুষম খাদ্যতালিকা

 

 

সারণি ২১ ও ২২-এ যথাক্রমে ১০০-১৫০ এবং ২০০-২৫০ কেজি ওজনের গাভীর সুষম খাদ্যতালিকার একটি করে নমুনা দেখানো হয়েছে।

সারণি ২১ঃ ১০০-১৫০ কেজি ওজনের গাভীর সুষম খাদ্যতালিকা

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য :

৫ কেজি খড়ের উপর ইউরিয়া মেশানো পানি (৫%) ভালোভাবে ছিটিয়ে দিয়ে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ৩/৪ দিন পলিথিন কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। খড় ও সবুজ ঘাস একসাথে খাওয়াতে হবে। আর দানাদার খাদ্যের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে আলাদাভাবে খাওয়ানো উচিত।

সারণি ২২ঃ ২০০-২৫০ কেজি ওজনের দুগ্ধবতী গাভীর সুষম খাদ্যতালিকা

 

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য :

ধানের খড় ও সবুজ ঘাস একসাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। ইউরিয়া, গমের ভুশি/কুড়া, তিলের খৈল ও লবণ একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।

গাভীর খাদ্য সংরক্ষণ

গাভীর খাদ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারলে যেমন নষ্ট হয়ে যেতে পারে তেমনি অপর্যাপ্ত সংরক্ষণে খাদ্যের গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই খাদ্য খেয়ে গাভীর রোগব্যাধি হতে পারে। আমাদের দেশে পশু খাদ্য সংরক্ষণের সমস্যা রয়েছে, বিশেষ করে দানাদার খাদ্য। উষ্ণ ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে এসব খাদ্য সহজেই পচে যায়। এর প্রধান কারণ আমাদের উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়ায় ছত্রাকজাতীয় উদ্ভিদের বংশবিস্তার ব্যাপক হয় ও সহজে অন্যান্য রোগজীবাণু জন্মায়। কাজেই সব সময় শুকনো পরিবেশে পশু খাদ্য সংরক্ষণ করা উচিত।

এছাড়া খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুতকরণেও সমস্যা থেকে যায়। মোটা আঁশযুক্ত খাদ্য যেমন কেটে টুকরো টুকরো করার প্রয়োজন রয়েছে তেমনি সহজপাচ্য হওয়ার জন্য কিছু কিছু বীজজাতীয় খাদ্য চূর্ণ করারও প্রয়োজন রয়েছে। কেননা গাভী সব সময় শক্ত বীজ পরিপূর্ণভাবে চিবানো ছাড়াই গিলে ফেলে।

এতে পাকস্থলীতে পাচক রস তেমনভাবে কাজ করে না। ফলে পাচক রসের অপচয় ঘটে। পরিপাকতন্ত থেকে এগুলো মলের সাথে আস্তই বের হয়ে আসে। এই কারণে শক্ত বীজজাতীয় খাদ্য চূর্ণ করেই পরিবেশন করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে খাদ্যদ্রব্য কেটে কুচি কুচি করে (chopping), কিছু ক্ষেত্রে রান্না করে বা ভিজিয়ে খাওয়াতে হতে পারে। খাদ্যদ্রব্যের পুষ্টিমান অক্ষুন্ন রেখেই এভাবে প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজন রয়েছে।

খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ

বহুকাল থেকেই গবাদিপশুর খাদ্যকে প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রচেষ্টা চলছে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করার উদ্দেশ্য হলো-

বহুকাল আগে থেকেই ধানের খড়কে কস্টিক সোডা (১%) মিশ্রিত পানি দিয়ে শোধন করে দেখা গেছে যে, খড় বেশ নরম হয়, ফলে গাভী স্বাভাবিকের তুলনায় কিছু বেশি খড় খায় এবং হজমও হয় বেশ তাড়াতাড়ি। চুন মেশানো পানি দিয়েও প্রায় একই রকম করে খড় শোধন করা যায়। এতে ফলও হয় একই প্রকার। কিন্তু এধরনের ক্ষার (alkali) শোধন প্রক্রিয়া সাধারণ কৃষক বা খামার মালিক পছন্দ করেন না। এই ধরনের শোধন পদ্ধতিতে কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন- এতে বড় বড় চৌবাচ্চা লাগে। রাসায়নিক দ্রব্য ও অতিরিক্ত শ্রমিক ও সময়ের প্রয়োজন হয়।

বর্তমানে ইউরিয়া (৫%) দিয়ে শোধনে ধানের খড়ের গুণগত মান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা জানি, ধানের খড় সেলুলোজ (cellulose) ও হেমিসেলুলোজ (hemicellulose) নামক দুপ্রকার শ্বেতসার এবং লিগনিন (lignin) নামক একপ্রকার কঠিন পদার্থ দিয়ে জটিলভাবে আচ্ছাদিত থাকে। রোমন্থক প্রাণীর পাকস্থলীতে যে অজস্র অনুজীব থাকে, সেগুলোর পক্ষে লিগনিনের আবরণ ভেদ করে সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ সময় লাগে।

প্রমাণিত হয়েছে যে, ৫% ইউরিয়া পানিতে মিশিয়ে খড়ের উপর সমভাবে ছিটালে ও সে খড়কে কিছুদিন আচ্ছাদিত করে রাখলে লিগনিন নরম হয়ে যায় এবং গবাদিপশু সে খাদ্য খেলে তা অতি সহজে হজম হয়ে যায়। খড়ের মাধ্যমে ইউরিয়া পাকস্থলীতে গিয়ে অ্যামোনিয়াতে রূপান্তরিত হয় এবং সে অ্যামোনিয়ার প্রভাবে হজম প্রক্রিয়ায় সহায়ক এসব অনুজীবের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। রোমন্থক প্রাণী অনামিষ নাইট্রোজেনযুক্ত পদার্থকে (N.P.N. or non-protien nitrogenous substance) আমিষে রূপান্তরিত করতে পারে ।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version