আমাদের আজকের আর্টিকেলটি গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ও রোগপ্রতিরোধ পদ্ধতি সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৫ এর অন্তর্ভুক্ত |
গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ও রোগপ্রতিরোধ পদ্ধতি
গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন বিষয়ে ইতোমধ্যেই গাভীর বাসস্থান ও পরিচর্যা পাঠ থেকে আমরা কিছুটা জেনেছি। এই পাঠে গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন বলতে এমন কতগুলো স্বাস্থ্যগত বিধিব্যবস্থাকে বোঝায় যা এযাবৎকাল সারা পৃথিবীতে পশুসম্পদ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এগুলো হলো-
১. বাসস্থান নির্মাণে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা ও দুর্যোগ নিবারণ করা,
২. খাদ্য ও পানির পাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা,
৩. প্রজনন ও প্রসবে জীবাণুমুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা,
৪. মলমূত্র নিষ্কাশন করা, ৫. অসুস্থ গাভী পৃথকীকরণ ও মৃত গাভীর সৎকার
৬. নিয়মিত কৃমিনাশক ব্যবহার করা, ৭. সংক্রামক ব্যাধির প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করা ইত্যাদি।
এখানে এগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
১. বাসস্থান নির্মাণে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা ও দুর্যোগ নিবারণ করা
গোশালা এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে যাতে গাভীর জন্য পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকে। একই সাথে এতে গাভীকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করারও ব্যবস্থা থাকতে হবে। যে কোনো মধ্যম আকারের গাভী প্রতিদিন ৯০.১ কেজির (২০০ পাউন্ড) অধিক বাতাস গ্রহণ করে।
প্রশ্বাসকৃত বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের (CO2) আধিক্য ০.০৩% থেকে ৫.৫৩%-এ উন্নীত হয়। আর অক্সিজেনের পরিমাণ ২০.৯৪% থেকে ১৪.২৯%-এ কমে যায়। একটি গাভী থেকে অন্যটি কমপক্ষে ১.৫ মিটার (৫ ফুট) দূরে রাখা উচিত। গোশালা নির্মাণের সময় এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। গোশালার জায়গা বরাদ্দও এই ভিত্তিতেই করতে হবে। এতে গাভীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
২. খাদ্য ও পানির পাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা
খাদ্য ও পানির পাত্র সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কারণ, পাত্র অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা থাকলে এতে সহজেই বিভিন্ন রোগজীবাণু বাসা বাধবে ও ফলে গাভীর রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। কাজেই এই দিকটায় বিশেষ নজর দিতে হবে।
৩. প্রজনন ও প্রসবে জীবাণুমুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা
প্রজনন ও প্রসবের মাধ্যমে গাভীতে রোগব্যাধি ছড়াতে পারে। সাধারণত প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ষাঁড়ের মাধ্যমে প্রজনন করালে এই সম্ভাবনাটা বেশি থাকে। কৃত্রিম প্রজননে রোগব্যাধি ছড়ানোর প্রকোপ অনেক কমে যায়। কিন্তু তা যদি নির্জীবাণু পদ্ধতিতে করা না হয় তাহলে রোগব্যাধি ছড়াতে পারে, বিশেষ করে যৌন রোগসমূহ। সুতরাং কৃত্রিম প্রজননের প্রতিটি পদক্ষেপ নির্জীবাণু পদ্ধতিতে করতে হবে। তবেই যৌনব্যাধি ছড়ানো বন্ধ হতে পারে।
তাছাড়া প্রসবকালেও যথারীতি ধাত্রীবিদ্যার নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। তা না হলে গাভী রোগজীবাণু কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে। প্রতিটি ডেয়রি ফার্ম বা পারিবারিক দুগ্ধ খামারে জীবাণুমুক্ত ধাত্রীকক্ষ রাখতে হবে। নির্জীবাণু পদ্ধতি ব্যবহারের সর্বোত্তম পন্থা হলো পরিষ্কার ও ফুটানো পানি দিয়ে যন্ত্র পাতি ধৌত করা। বাণিজ্যিকভিত্তিতে পরিচালিত বড় দুগ্ধ খামারগুলোতে অটোক্লেভ (autoclave) নামক যন্ত্র দিয়ে যন্ত্র পাতি জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা হয় ।
৪. মলমূত্র নিষ্কাশন করা
ডেয়রি ফার্ম বা পারিবারিক দুগ্ধ খামার যেখানেই গাভী লালনপালন করা হবে সেখানেই মলমূত্র নির্গমণ ও নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। গাভীর বাসস্থানে সেরকম নর্দমা ও পয়ঃপ্রনালী তৈরি করতে হবে যাতে মলমূত্র উপজাত হিসেবে সার বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করা যায়। প্রতিদিন অন্তত একবার পানি ঢেলে গোশালা পরিষ্কার করতে হবে। মাসে অন্তত একবার জীবাণুনাশক ওষুধ, যেমন- ফিনাইল (phenyle) বা আয়োসান (iosan) দিয়ে শোধন করতে হবে। এতে মলমূত্র থেকে গাভীতে রোগব্যাধি ছড়ানো ও পরিবেশ দুষিত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।
৫. অসুস্থ গাভী পৃথকীকরণ ও মৃত গাভীর সৎকার করা
যে কোনো দুগ্ধ খামারে মৃত গাভীর সৎকার করার যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে। গাভী কোনো সংক্রামক রোগে মারা গেলে তার সৎকার প্রয়োজন। মৃত গাভীর শবদেহ মাটির ০.৫ মিটার নিচে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে এবং উপরিভাগে চুন বা ডি.ডি.টি. (D.D.T.) ছড়িয়ে শোধন করতে হবে। আর অসুস্থ গাভীগুলোকে আলাদা কক্ষে রাখা উচিত, বিশেষ করে অসুখটি যদি কোনো সংক্রামক ব্যাধি হয়। ছোঁয়াচে গর্ভপাত বা ব্রুসেলোসিস রোগ হলে তা স্বাস্থ্যসম্মত বিধিব্যবস্থা দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ছোঁয়াচে গর্ভপাত গাভীর একটি মারাত্বক ব্যাধি। স্যাঁতস্যাঁতে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই রোগের বিস্তার ঘটে। এই রোগের উৎস সব সময়ই কোনো না কোনো প্রসূতি গাভী। প্রসূতি কক্ষে কোনো গাভী থাকাকালীন ৩-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত অন্য সুস্থ গাভীর সংশ্রবে আনা যাবে না। একাধিক গাভী প্রসূতি হলে ঘরের মধ্যে বেড়া দিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে। বাচ্চা প্রসবের পরে প্রসূতি কক্ষগুলো পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে শোধন করতে হবে। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো ওষুধ দেয়া যেতে পারে ।
৬. নিয়মিত কৃমিনাশক ব্যবহার করা
কৃমির ডিম যত্রতত্র বেঁচে থাকার জন্য বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষ উপযোগী। বিভিন্ন ধরনের মাছি, মশা, উকুন, আটালি, অন্যান্য কীটপতঙ্গ ও শামুক কৃমিসহ বেশ কিছু রোগের বাহক। এরা নিজেরাই
আবার পরজীবী হিসেবে গাভীর দেহে আশ্রয় নিয়ে বেশ কিছু রোগ সৃষ্টি করে। সুতরাং বহিঃ ও অন্ত ঃ উভয় পরজীবীর বিরুদ্ধেই কৃমিনাশক ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়, বিশেষ করে যকৃৎ ও অন্ননালীর কৃমির জন্য তো বটেই। এছাড়াও রয়েছে কতগুলো এককোষী পরজীবী। বিভিন্ন প্রজাতির কৃমির বিরুদ্ধে কাজ করে এমন কৃমিনাশক ওষুধ নিকটস্থ ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো নিয়মিত ব্যবহার করে গাভীর কৃমি দমন করা যায় ।
৭. সংক্রামক ব্যাধির প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করা
গাভীর সংক্রামক ব্যাধির মধ্যে খুরা রোগ (foot and mouth disease), তড়কা ( anthrax), বাদলা (black quarter), গলাফোলা (haemorrhagic Septicaenia), সংক্রামক গর্ভপাত (brucellosis), জলাতঙ্ক (rabies) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ম্যাস্টাইটিস (mastitis) বা ওলানপ্রদাহ দুগ্ধবতী গাভীর একটি অতি সাধারণ রোগ।
উপরোক্ত রোগগুলোর প্রতিষেধক বা টিকা সরকারীভাবে এদেশে তৈরি হয় এবং তা বিভিন্ন পশু হাসপাতাল ও ডিপেনসারিতে সরবরাহ করা হয়। কাজেই নিকটস্থ ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো গাভীকে নিয়মিত এসব সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা দেয়া পশু রোগ নিবারণের সর্বোত্তম পন্থা। অবশ্য ওলানপ্রদাহের কোনো প্রতিষেধক টিকা নেই। এজন্য ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো চিকিৎসা করাই উত্তম।
সারণি ২৩-এ বাংলাদেশে প্রস্তুত গাভীর বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকার নাম, ব্যবহার মাত্রা, প্রয়োগ পদ্ধতি ও সময় উলে-খ করা হয়েছে।
সারণি ২৩ : বাংলাদেশে প্রস্তুত গাভীর বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকার নাম, ব্যবহার মাত্রা, প্রয়োগ পদ্ধতি ও সময়
আরও দেখুনঃ