ছাগলের রোগব্যাধি দমন

আমাদের আজকের আর্টিকেলটি ছাগলের রোগব্যাধি দমন সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৬ এর অন্তর্ভুক্ত |

ছাগলের রোগব্যাধি দমন

 

ছাগলের রোগব্যাধি দমন

 

এদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ছাগলের রোগব্যাধি কম হয়। কথাটি অল্প সংখ্যক ছাগলের ক্ষেত্রে সত্য হলেও যেখানে বেশি সংখ্যায় ছাগল পালন করা হয় (অর্থাৎ খামার) সেখানকার সত্য নয় ।
কারণ, খামারে কাছাকাছি থাকার কারণে কোনো ছাগল সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে অন্যরাও সহজেই সে রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। খামারে পালিত ছাগলের রোগব্যাধি এদের বংশবৃদ্ধি ও উৎপাদন বৃদ্ধির অন্তরায়। তবে, এদেশে গরুর তুলনায় ছাগলের রোগ বেশ কম হয় ।

চিকিৎসা শাস্তে একটি কথা প্রচলিত আছে ‘চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। অর্থাৎ রোগ হলে চিকিৎসা করা হবে সে আশায় না থেকে আগে থেকেই এমন কতকগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন রোগই না হয়। তাহলেই রোগ দমন সহজ হবে। ছাগলের রোগ দমনেও এই কথাটির প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

ছাগলের রোগব্যাধি সঠিকভাবে দমন করতে পারলে এদেশে ছাগলের সংখ্যা ও উৎপাদন প্রত্যেকটিই যথাক্রমে প্রায় ৩০% করে বৃদ্ধি পাবে। ছাগলের বিভিন্ন ধরনের রোগ দমনে জাতীয়ভিত্তিক কার্যক্রমের পাশাপাশি পালনকারিকে কিছু ব্যক্তিগত কার্যক্রমও গ্রহণ করতে হবে। এসব পদক্ষেপ সুষ্ঠুভাবে গ্রহণ ও সম্পাদন করতে পারলে ছাগলের রোগব্যাধি দমন সহজতর হবে।

জাতীয়ভিত্তিক কার্যক্রম

এজাতীয় কার্যক্রম প্রধানত সরকার গ্রহণ করবে। তবে, সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা (এন.জি.ও.) ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও সংশ্লিষ্ট থাকতে পারেন। জাতীয়ভিত্তিক কার্যক্রমের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর সুষ্ঠু সম্পাদন ছাগলের রোগব্যাধি দমনের পূর্বশর্ত। যথা-

  • ছাগলের সংখ্যা নির্ধারণ বা শুমারি।
  • ছাগল চিহ্নিতকরণ।
  • ছাগলের রোগব্যাধির অনুসন্ধান ও নির্ণয়। ছাগলের রোগব্যাধি নিয়ে গবেষণা।
  • রোগপ্রতিরোধ আইনের প্রয়োগ।
  • রোগ সম্পর্কে রিপোর্টিং।
  • ছাগলের রোগপ্রতিষেধক ইনজেকশন বা টিকার ব্যবহার। বেআইনিভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ছাগল আমদানি করা ।

ব্যক্তিগত কার্যক্রম

প্রতিটি ছাগল খামারিকে রোগব্যাধি দমনের জন্য নিজস্ব কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এগুলো সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো-

  • ছাগলের ঘরদোর, খাদ্য ও পানির পাত্র এবং অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এদের গোবর ও চনা সঠিকভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
  • বিভিন্ন বয়সের ছাগলকে আলাদা আলাদা ঘরে বা খোপে (pen) পালন করতে হবে।
  • সব সময় সুষম খাদ্য প্রদান করতে হবে। পচা বা বাসি খাবার সরবরাহ করা যাবে না।
  • বাজার থেকে কিনে আনা নতুন ছাগল খামারের অন্যান্য ছাগলের সঙ্গে রাখার পূর্বে অন্তত কয়েকদিন আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে সে কোনো রোগে আক্রান্ত কি-না।
  • কোনো ছাগলের মধ্যে অসুস্থতার লক্ষণ দেখামাত্র তাকে আলাদা করে ফেলতে হবে এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • সংক্রামক রোগে মৃত ছাগলকে খামার থেকে দূরে মাটির নিচে গভীর গর্ত করে তাতে মাটি চাপা দিতে হবে এবং উপরিভাগে চুন বা ডি.ডি.টি. (D.D.T.) ছড়িয়ে শোধন করতে হবে।
  • সব বয়সের ছাগলকে নিয়মিতভাবে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে ও সংক্রামক রোগপ্রতিরোধের জন্য টিকা প্রদান করতে হবে।
  • ছাগলের প্রধান শত্রু ঠান্ডা বা বৃষ্টির পানির কবল থেকে রক্ষা করতে হবে।

ছাগলের গুরুত্বপূর্ণ রোগ ও প্রতিকার

ছাগল জীবাণুঘটিত, পরজীবীঘটিত, অপুষ্টিজনিত, বিপাকীয় ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এসব রোগের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কটি রোগ এখানে আলোচিত হয়েছে।

তড়কা (Anthrax)

তড়কা বা অ্যান্থ্রাক্স ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এই জীবাণুটি খাদ্য, পানি, ক্ষত বা শ্বাসের সঙ্গে ছাগলের দেহে প্রবেশ করে। দেহে প্রবেশের ১-৫ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা যায়। অনেক সময় কোনো লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই ছাগল মারা যায়। মৃত ছাগলের নাক, মুখ বা পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্ত বের হতে দেখা যায় ।

লক্ষণ

হঠাৎ করে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়। জাবর কাটে না, লোম খাড়া হয়ে যায় এবং কাঁপতে থাকে । পেট ফুলে ওঠে। দেহের তাপমাত্রা ৪১° সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠতে পারে । শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এ রোগে মৃত ছাগলের ময়না তদন্ত করা বা চামড়া ছাড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । কারণ, এই রোগের জীবাণু মাটিতে ৪০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে এবং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীকেও আক্রান্ত করতে পারে ।

চিকিৎসা

যে কোনো একটি অ্যান্টিবায়োটিক ( antibiotic) ওষুধ ভেটেরিনারি সার্জনের নির্দেশিত মাত্রায় প্রয়োগ করে সাফল্যজনকভাবে চিকিৎসা করা যেতে পারে। যেমন- পেনিসিলিন, অ্যাম্পিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন ইত্যাদি ।

প্রতিরোধ

এই রোগের প্রতিষেধক টিকা সুস্থ অবস্থায় ছাগলে বছরে একবার প্রয়োগ করতে হয়।

নিউমোনিয়া (Pneumonia)

ফুসফুসের প্রদাহকে নিউমোনিয়া বলে। বহু কারণে এই রোগ হতে পারে। যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী, ছত্রাক প্রভৃতির আক্রমণে। কাজেই এটি একটি জটিল রোগ, এই রোগের জীবাণু বা পরজীবীগুলো খাদ্য ও পানি, রোগাক্রান্ত ছাগলের স্পর্শ বা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ছড়াতে পারে ।

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

লক্ষণ

দেহের তাপমাত্রা ৪১° সে. পর্যন্ত ওঠতে পারে। শ্বাসপ্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়। কাশি হয়, নাক দিয়ে সর্দি ঝড়ে। জিহ্বা ফুলে যায় ও তা বের করে রাখে। খাদ্যে অরুচি হয়, জাবর কাটা বন্ধ হয়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে ও শুয়ে থাকতে পছন্দ করে।

চিকিৎসা

উল্লেখিত যে কোনো একটি সালফোনেমাইড গ্রুপের বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করলে সুফল পাওয়া যায়। তবে, একাধিক রোগজীবাণু জড়িত থাকায় সঠিক ওষুধ নির্বাচন করতে হবে। যেমন- সালফাডিমিডিন, পেনিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন, অ্যাম্পিসিলিন, টাইলুসিন প্রভৃতি।

খুরা বা বাতা রোগ (Foot and mouth disease)

এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ যা সাধারণত বিভক্ত খুরবিশিষ্ট প্রাণী, যেমন- গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, শুকর, হরিণ প্রভৃতিতে হয়। এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র ভাইরাস এজন্য দায়ী।

লক্ষণ

প্রথমে জ্বর হয়। মুখের ভেতরে, ঠোঁটে, জিহ্বায় দুই খুরের মাঝখানে পানির ন্যায় রসপূর্ণ ফোস্কা ওঠে। খাওয়ার সময় ঘষা লেগে ফোস্কাগুলো ফেটে গিয়ে লাল রঙের ঘায়ে পরিণত হয়। ঘায়ের কারণে মুখ থেকে প্রচুর লালা ঝড়ে। পায়ে ফোস্কা হয় ও তা ফেটে ঘা হয়। পা ফুলে ওঠে ও পায়ের ঘায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ওলানেও ফোস্কা ওঠতে পারে। ঘায়ে পোকা পড়তে পারে ।

চিকিৎসা

এই রোগের সঠিক কোনো চিকিৎসা নেই। তবে, অন্যান্য রোগজীবাণু দিয়ে যাতে ক্ষত সংক্রমিত না হয় সেজন্য অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। তাছাড়া ক্ষত বা ঘা অ্যান্টিসেপটিক ওষুধ দিয়ে রোজ দুতিনবার ধুয়ে অ্যান্টিসেপটিক পাউডার লাগাতে হবে।

প্রতিরোধ

প্রতি ৪-৬ মাস পর পর নির্ধারিত মাত্রায় ছাগলকে খুরা রোগের প্রতিষেধক টিকা প্ৰয়োগ ៖
করতে হবে।

এন্টারোটক্সিমিয়া (Enterotoxemia)

ক্লসট্রিডিয়াম প্রজাতির (Clostridium spp.) ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক উৎপাদিত টক্সিন বা বিষের কারণে এই রোগের সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র দানাদার খাদ্য খাওয়ালে অন্তে বসবাসকারী এই ব্যাকটেরিয়াগুলো তাড়াতাড়ি বংশ বৃদ্ধি করে ও এদের টক্সিন উৎপাদনের মাত্রা বেড়ে যায়।

লক্ষণ

আক্রান্ত ছাগল হঠাৎ মারা যেতে পারে। ছাগল হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, দেহ কাঁপতে থাকে । ঘুরতে থাকে, কোনো শক্ত বস্তুর সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে রাখে। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। পাতলা পায়খানা হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছাগল মারা যায় ।

চিকিৎসা

চিকিৎসা করে সব সময় সুফল পাওয়া যায় না। পেনিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিনজাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে মাঝে মাঝে উপকার পাওয়া যায়।

কৃমি রোগ (Worm infestation)

প্রাপ্তবয়স্ক ছাগলের চেয়ে অল্পবয়স্ক ছাগলই কৃমি রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ফিতাকৃমি এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক পাতাকৃমি দিয়েই ছাগল বেশি আক্রান্ত হয় ।

লক্ষণ

আক্রান্ত ছাগলের পেট বড় হয়ে যায় এবং ছাগল ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে যায় ও কমনীয়তা নষ্ট হয়। মলের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কৃমির অংশ বের হয়ে আসে। ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়। পাতলা পায়খানাও করতে পারে।

 

ছাগলের রোগব্যাধি দমন

 

চিকিৎসা

গবাদিপশুর কৃমি নিবারণের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন কৃমিনাশক ওষুধ, যেমন- মেবেন্ডাজল, ៖ ক্যামবোজল, থায়োফিনেট প্রভৃতি সঠিক মাত্রায় সেবনের মাধ্যমে সহজেই এই রোগ নিরাময় করা যায়। তবে, এ রোগের আক্রমণ থেকে পশুকে রক্ষা করার জন্য ডোবা ও জলাশয় থেকে সংগৃহীত ঘাস বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে খাওয়াতে হবে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment