দারিদ্র দূরীকরণ ও আত্মকর্মসংস্থানে পশুর গুরুত্ব

আমাদের আজকের আর্টিকেলটি দারিদ্র দূরীকরণ ও আত্মকর্মসংস্থানে পশুর গুরুত্ব সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট-১ এর অন্তর্ভুক্ত |

দারিদ্র দূরীকরণ ও আত্মকর্মসংস্থানে পশুর গুরুত্ব

 

দারিদ্র দূরীকরণ ও আত্মকর্মসংস্থানে পশুর গুরুত্ব

 

আত্মকর্মসংস্থান

কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান এক নয়। জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজ করার সুযোগকে কর্মসংস্থান বলে। আর নিজের চেষ্টায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে কর্মে আত্মনিয়োগ করাকে আত্মকর্মসংস্থান বলে। আত্মকর্মসংস্থান মানুষের চাহিদা মিটিয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়ন করে বলে এটি মানুষের দারিদ্র দূরীকরণে সহায়তা করে। পৃথিবীতে আবির্ভাবের পর মানুষকে প্রথম কর্মসংস্থানের সন্ধান দিয়েছিল পশু। তারপর পর্যায়ক্রমে বুদ্ধি বিকাশের সাথে সাথে পশুকে কেন্দ্র করে মানুষ নিজে নিজে বিভিন্নমুখী আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে।

মূলে ছিল মানুষের আত্মপ্রচেষ্টার প্রয়োজন আর পশুর অবদান। পশু মানুষকে প্রয়োজনভিত্তিক চাহিদা মেটানো ছাড়াও প্রয়োজনোতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের পথ দেখিয়ে দারিদ্র দূরীকরণে যুগে যুগে ভূমিকা পালন করে এসেছে। সুতরাং আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণের পূর্ব ইতিহাস উল্লেখ করা প্রয়োজন।

আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে বিভিন্ন যুগে পশুর ভূমিকা

বর্বর যুগে মানবজাতি সভ্য ছিল না। পশুর সঙ্গে একসাথে বাস করত। পশুর মাংস ভক্ষন করে ক্ষুধা নিবারণ করত। চামড়া পরিধান করে লজ্জা নিবারণ করত। তাই তারা পশু শিকার করার জন্য জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। শিকার করার জন্য নানা রকমের যন্ত্র বানাত। এভাবে মানব জাতির প্রথম আত্মকর্মসংস্থানের উদ্ভব হয়েছিল যাকে শিকার করা বলে। সেকালে যারা শিকার ধরতে পারত তাদের খাওয়াপরার চাহিদা মিটে যেত, ফলে তাদের আর অভাব থাকত না অর্থাৎ দারিদ্র দূর হতো।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রাচীনকালেও পশু মানুষের দারিদ্র দূরীকরণে প্রথম স্থানে ছিল। মানুষ যখন কিছুটা সভ্য হলো, আবাসস্থল গড়ে তুললো। গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল পালন করতে শুরু করল। মাঠে পশু চরানোর জন্য রাখাল নিয়োগ করল। এমনিভাবে রাখালি পেশার উদ্ভব হলো। আজও ভারত, বাংলাদেশের গ্রামে বহু ছেলে এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে।

পরবর্তীকালে সময়ের সাথে সাথে কৃষি, পরিবহণ, খাদ্য উৎপাদন প্রভৃতি কাজে পশুর ব্যবহার আরও বিস্তার লাভ করল। পশুকেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের পেশার উদ্ভব হলো। বিভিন্ন পেশাবলম্বী মানুষ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হলো, যেমন- গোয়ালা, কলু, কৃষক, গাড়োয়ান, ময়রা প্রভৃতি। এদের মধ্যে দুধ বিক্রির পেশা যারা বেছে নিলো তাদের গোয়ালা, পশুর গাড়ি চালকদের গাড়োয়ান, গরু দিয়ে ঘানি থেকে তেল উৎপাদন ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কলু, আর ফসল ফলানো যাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় হলো তারা কৃষক বলে সমাজে পরিচিত হলো। এসব পেশার প্রত্যেকটির সঙ্গেই পশুর সম্পর্ক রয়েছে।

এরপর এল বিজ্ঞান ও শিল্প যুগ। আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে পশুর ভূমিকা আরও ব্যাপক হলো। শিল্পোন্নত দেশ, যেমন- ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি পশুসম্পদের উপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাটালো। ফলে তারা প্রয়োজনোতিরিক্ত দুধ, মাংস উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং দুধ- মাংসজাত দ্রব্য উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করতে লাগল। অন্যদিকে, পশু উপজাত দ্রব্য, যেমন- চামড়া, পশম, চর্বি, হাড়, রক্ত, খুর, শিং থেকে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় ও সৌখিন দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুত করে দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে লাগল।

বর্তমান বিশ্বে তারা ধনী দেশ বলে গণ্য হচ্ছে। বর্তমানে সেসব দেশের বড় বড় খামার ও উপজাত দ্রব্যের শিল্প প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আগত বহু লোক কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শিল্প, কৃষি ও ব্যবসা সম্প্রসারণে পশুসম্পদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখে ব্যক্তি, দেশ ও জাতির আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে বিরাট ভূমিকা পালন করছে।

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

বাংলাদেশে আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে গবাদিপশুর ভূমিকা

বাংলাদেশের জন্য গৃহপালিত পশু এক বিরাট সম্পদ। এদেশের আবহাওয়া পশুপালনের জন্য উপযুক্ত। গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে গরু, ছাগল, মহিষ পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু এখনও বহু জায়গায় সনাতন পদ্ধতিতে পশুপালন করা হচ্ছে। সেজন্য পশু আমাদের বড় সম্পদ হওয়া সত্ত্বেও এদেশের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র ও বেকার।

সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পশুপালন করলে খুব সহজে কর্মসংস্থানের উপায় হবে। কর্মসংস্থানের উপায় হলে আর্থিক সচ্ছলতা আসবে ও দরিদ্রতা দূর হবে। নিম্নে আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে ছাগল, গরু, ভেড়া ও মহিষ কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারে সংক্ষেপে তা আলোকপাত করা হয়েছে।

ছাগল

দারিদ্র দূরীকরণ ও আত্মকর্মসংস্থানে ছাগলের স্থান প্রথম। ছাগলকে গরীবের গাভী বলা হয়। ছাগল ছানার দাম অত্যন্ত কম। বিত্তহীন, ভূমিহীন দরিদ্র ব্যক্তি, যে কেউ দুটো ছানা ক্রয় করে পালন শুরু করতে পারেন। এগুলো পালন করতে শ্রম কম লাগে। বাড়ির আশেপাশে, জমির আইলে চরালে ও অল্প খাবার দিলেই চলে।

বাসস্থান ও চিকিৎসা খরচ কম। দেশী ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বছরে দুবার ২- ৪টি করে মোট ৪-৮টি বাচ্চা প্রসব করে। এ জাতের ছাগলের মাংস ও চামড়ার যথেষ্ট চাহিদা। তাই বেশি মূল্যে বিক্রি করা যায়। যমুনাপারি ছাগল দুধের জন্য পালন করা হয়। ছাগলের সংখ্যা বাড়িয়ে খামার করা যায়। এভাবে একজন বেকার ব্যক্তি একটি খামারের মালিক হতে পারেন। তারপর সে খামার বড় করে তাতে লোক নিয়োগ করতে পারেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দরিদ্র বেকার লোক নিজের চেষ্টায় খামার গড়ে তুলতে পারেন ও সেসব খামারে বহু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।

গরু

হিসাব নিকাশ করে দেখা গেছে, একটি পরিবারে সংকর জাতের দুটি গাভী থাকলে তাদের আর্থিক অসচ্ছলতায় কষ্ট পেতে হয় না। অর্ধ বেকার, বেকার, দরিদ্র কৃষক কাজের সন্ধান পায়। যারা দরিদ্র তারা সহজ শর্তে সরকার থেকে ঋণ নিয়ে উন্নত জাতের গাভী, যেমন- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান বাছুর ক্রয় করতে পারেন। তাছাড়া খুব কম মূল্যে দেশী গাভীর বকনা বাছুর ক্রয় করে পালন করা যায়। এক্ষেত্রে বাছুরটি প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিদেশী উন্নত জাতের ষাড়ের বীজ দিয়ে প্রজনন করিয়ে উন্নত সংকর জাতের বাছুর উৎপাদন করা যায়।

উৎপন্ন বাছুর যদি ষাঁড় হয় তাহলে তা বেশি মূল্যে বাজারে বিক্রি করতে পারেন অথবা নিজে পালন করে শক্তি ও প্রজননের জন্য ব্যবসা করতে পারেন। বকনা বাছুর হলে তা পালন করে দুধের ব্যবসা করা যায়। ছাগলের মতো ধীরে ধীরে গাভীর সংখ্যা বাড়িয়ে গাভীর খামার তৈরি করা যায়। তাতে নিজের এবং আরও বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। তাছাড়া গবাদিপশুর খামারের সাথে সাথে গড়ে ওঠে খাদ্য ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি তৈরির শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ।

ভেড়া

বাংলাদেশে ভেড়ার জাত অনুন্নত। তথাপি ভেড়ার মাংসের ব্যবসা করা যায়। কারণ, ভেড়ার মাংস ছাগলের মাংসের মতোই সুস্বাদু। এছাড়া দেশী ভেড়াকে উন্নত জাতের ভেড়ার সাথে প্রজনন করানো যায়। এভাবে জাত উন্নয়ন করে দেশী ভেড়া থেকে উৎকৃষ্টমানের পশম উৎপাদন করা যায়। এ পশম দিয়ে শীতবস্ত্র তৈরি করা যায় অথবা কাঁচামাল হিসেবে বিদেশে রপ্তানি করা যায়। দেশী ভেড়ার পশম দিয়ে কার্পেট ও কম্বল তৈরির কাজে বেকার ব্যক্তিরা নিয়োজিত থাকলে বেকার সমস্যা দূরীকরণ ও অর্থ উপার্জন হবে। এতে ভেড়ার বদৌলতে আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্রতা দূর হবে।

মহিষ

এদেশের মানুষের আত্মকর্মসংস্থানে মহিষের ভূমিকাও কম নয়। একজোড়া মহিষ এক টন পর্যন্ত ভার বহন করতে পারে। মহিষের মালিক মহিষের গাড়ি ভাড়া দিতে পারেন, নিজের জমি চাষে ব্যবহার করতে পারেন অথবা অন্যের জমি চাষের জন্য ভাড়া দিতে পারেন। মহিষের দুধে চর্বির পরিমাণ গড়ে ৬%। যারা মহিষ পালন করেন, মহিষের দুধ দিয়ে মাখন, ঘি, দই, মিষ্টি, পনির তৈরি করে ব্যবসা করতে পারেন। ২৪ মাসের কম বয়সের মহিষের বাছুর জবাই করে মাংস বিক্রি করা যায়। কারণ, এ বয়সের বাছুরের মাংস গরুর মাংসের মতোই খেতে সুস্বাদু এবং মাংসের আঁশ কম পুরু।

আত্মকর্মস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে পশু উপজাত দ্রব্যের ব্যবহার

আমাদের দেশে প্রতিদিন অসংখ্য পশু জবাই হয়। তাছাড়া কোরবানির সময়ের কথা বলাই বাহুল্য, এসব জবাইকৃত পশু উপজাত দ্রব্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করার জন্য বিপুল বেকার জনগোষ্ঠিকে বিভিন্ন কর্মকান্ডে লাগানো যেতে পারে।

তাতে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়। সরকার ও জনসাধারণের সমন্বয়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে পশু উপজাত দ্রব্যভিত্তিক বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারখানা এদেশে গড়ে ওঠবে। বেকার জনগণ পশু উপজাত ও বিভিন্নমুখী কর্মে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন। ব্যক্তি ও জাতীয় অর্থ উপার্জনের পথ আবিষ্কার হবে। ফলে ব্যক্তির আত্মকর্মস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণের সাথে সাথে আমাদের দেশও ঐশ্বর্যশালী হবে।

বাংলাদেশে আত্মকর্মস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে পশুকেন্দ্রিক কর্মসূচি

  • বেকার জনগোষ্ঠিকে উপজাত দ্রব্য সংগ্রহের কাজে লাগানো যেতে পারে।
  • উপজাত দ্রব্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ছাড়াও এগুলো থেকে বিভিন্ন সামগ্রী প্রস্তুত করার প্রশিক্ষণ কোর্সও চালু করা যেতে পারে।
  • প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের সাহায্যে বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে।  এতে এসব কাজেমানুষের আগ্রহ বাড়বে।
  • প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভালো বেতন ও পদমর্যাদা দেয়া যেতে পারে।

এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারলে বিদেশের মতো আমদের দেশেও বহু কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠবে।

 

দারিদ্র দূরীকরণ ও আত্মকর্মসংস্থানে পশুর গুরুত্ব

 

১৯৯২ সালে বাংলাদেশে আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে কিছু তথ্য

১৯৯২ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, একক ও মিশ্র খামার মিলে ৪৭.৬৪% প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবক আত্মকর্মসংস্থানে এবং ৪৭.৪৩% যুবক পশুপাখির প্রাথমিক চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়া ৪১.৭১% প্রকল্প গ্রহণকারী যুবক মাসে ৫০০ টাকা পর্যন্ত এবং ৩১.৯৬% যুবক প্রায় ৫০০-১০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেছেন।

এ দুয়ে মিলে ৭৩.৪% যুবক ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেছেন। একই পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১৯০৫ জন গ্রামীণ দুঃস্থ মহিলাকে গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি পালনে প্রশিক্ষণ দান করেছে। তাদের মধ্যে ৬০  জনের চাকুরি হয়েছে এবং ১০২০ জন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। তাদের মাসিক আয় গড়ে ৬০০- ১০০০ টাকা। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সহযোগিতায় দেশের অবহেলিত নারী সমাজও হাঁসমুরগি পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment