বাসস্থান ও পরিচর্যা

আমাদের আজকের আর্টিকেলটি বাসস্থান ও পরিচর্যা সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৪ এর অন্তর্ভুক্ত |

বাসস্থান ও পরিচর্যা

 

 

গরু মহিষের শৈশবকালকে বাছুর বলে। সাধারণত জন্মের পর থেকে এক বছরের কিছু বেশি বয়সের গরু মহিষের বাচ্ছাই বাছুর নামে পরিচিত। এই সময়ে বাছুরের শারীরবৃত্ত ও শারীরিক গঠন বৈশিষ্ট্য সাপেক্ষে বাসস্থান তৈরি করতে হয়। সংগে সংগে বাছুরের বয়স, খাদ্যাভ্যাস, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, আবহাওয়া ও রোগবালাই সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাব্যতাও বিবেচনা করতে হবে।

বাছুরের বর্ধিষ্ণু শারীরবৃত্তের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং খাদ্য পরিবেশন, যত্ন ও পরিচর্যার কথা বিবেচনা করে প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রতিরোধের জন্য বাসস্থান তৈরি করা উচিত। আমাদের দেশের বাছুরের জন্মের ওজন গড়ে ১৫-২০ কেজি হয়। অবশ্য উন্নত সংকর জাতের বাছুরের জন্মের ওজন ২৫-৩০ কেজি হয়ে থাকে। জাত ভিন্ন হওয়ায় তাদের বাসস্থান এবং পরিচর্যাও ভিন্ন হবে।

 

বাসস্থান ও পরিচর্যা

প্রতিটি বড় বাছুরের জন্য ১.৫২ মিটার x ২.১৩ মিটার = ৩.২৪ বর্গ মিটার অর্থাৎ ৫ ফুট × ৭ ফুট = ৩৫ বর্গ ফুট জায়গার ভিত্তিতে বাছুরের বাসস্থান তৈরি করা যায়। এই বাসস্থানে প্রচুর আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রেখে বৃষ্টিপাত ও বর্ষাকালের কর্দমাক্ত অবস্থা পরিহারের লক্ষ্যে পশুর বাসস্থান স্থাপন বাঞ্ছনীয়।

এই বাসস্থান কাঁচা অথবা পাকা হতে পারে। এতে বাছুরের মলমূত্র নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি ঘরে ছোট ছোট খোপ (calf pen) তৈরি করে প্রতি খোপে একটি করে বাছুর রেখে পালন করা যায়। সেক্ষেত্রে এ খোপগুলোর প্রতিটির পরিসর হবে ০.৯১ মিটার x ১.২২ মিটার × ১.০৭ মিটার অর্থাৎ ৩ ফুট × ৪ ফুট × ৩.৫ ফুট। অন্যদিকে, একটি নির্দিষ্ট আলো-বাতাস ব্যবস্থাসম্পন্ন ঘরে একসাথে সমবয়সী ৫-১০টি বাছুর পালন করা যায়।

তবে, উভয়ক্ষেত্রেই ঘরের সামনে বেষ্টনি ঘেরা খোলা জায়গা থাকা দরকার যাতে বাছুর ব্যায়াম ও খেলাধুলা করতে পারে । অনুশীলন (Activity) : ধরুন, আপনার খামারে ১২টি বাছুর আছে। এদেরকে আলাদা আলাদা খোপে রাখা হলে সর্বমোট কতটুকু জায়গার প্রয়োজন হবে। (সূত্রঃ একটির জন্য ০.৯১ মিটার ×১.২2 মিটার × ১.০৭ মিটার = ১.১৯ ঘন মিটার জায়গার প্রয়োজন) বাছুরের খোপে খড়বিচালি দিয়ে বিছানা তৈরি করতে হবে। মেঝে পাঁকা হলে ২.৫৪ সে.মি. বা এক ইঞ্চি পুরু বিছানার প্রয়োজন হয়।

মেঝে কাঁচা হলে তা যেন কর্দমাক্ত ও স্যাঁতস্যাঁতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা স্যাঁতস্যাঁতে ও নোংরা পরিবেশে বাছুর ফুসফুস প্রদাহ (Pneumonia) রোগে ভুগে থাকে। এই রোগ বাছুরের জন্য মাকে ক্ষতির কারণ হয়। ১.৫-২.০ মাস বয়সের বাছুরকে বড় বাছুরের বাসস্থানে স্থানান্তর করা উচিত যেখানে একসঙ্গে অনেক বাছুর প্রতিপালিত হয়। এককথায় বাসস্থান হবে আলোকিত, পরিষ্কার ও শুকনো।

বাছুরের পরিচর্যা

বাছুরের পরিচর্যা বলতে এদের খাদ্য পরিবেশন, রোগবালাই মুক্ত রাখা, দেখাশোনা করা ইত্যাদি বুঝায়। আমাদের দেশে বাছুর প্রতিপালনে আলাদা কোনো যত্ন ও সেবার রেওয়াজ নেই। কিন্তু এটি পশুপালন বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাছুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে দৈহিক পরিপক্কতা অর্জন করে সাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত এদের পালন করা হয়। এই সময়কালটা বাছুরের জন্মের দিন থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে বাছুর পরিচর্যার কলাকৌশল বর্ণনা করা হয়েছে।

১) বাছুরকে গাভীর দুধ পান করা শেখানো :

বাছুরকে দুধ পান করানো শেখাতে হয়। জন্মের পরই বাছুর তার মায়ের বাট থেকে দুধ চুষে নিতে পারে না। বাছুরকে তাই বাট মুখে পুরে দুধ টানা শেখাতে হয়। পারিবারিক খামারে তো বটেই, বৃহদাকার দুগ্ধ উৎপাদন খামারেও বাছুরকে হাতে তুলে পান করাতে হয়। গাভীর দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কম হলে তো কথাই নেই। সেক্ষেত্রে মা গাভী থেকে দোহনকৃত দুধের অতিরিক্ত দুধ পান করানোর প্রয়োজন হতে পারে।

বাছুরকে শৈশবে ৩৭.৫° সে. তাপমাত্রায় দুধ পান করানো হয়। এর দু’টো পদ্ধতি রয়েছে, যেমন- এক. বোতলে করে ও দুই. বালতিতে করে। তবে, বোতলে (nipple feeding) করে দুধ পান করানোর সুবিধা হলো এতে অপেক্ষাকৃত ছোট ঢোকে দুধ বাছুরের পাকস্থলীতে ঢুকে থাকে। এতে দুধের অপচয় কম হয়। বোতল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। বিশুদ্ধ পানি ও গরুর দুধ ১:২ অনুপাতে মিশিয়ে পাতলা করে পান করানো উত্তম ।

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

২) খামার পর্যায়ে বাছুর চিহ্নিতকরণ বা কানে ট্যাগ নম্বর লাগানো :

বাছুর চিহ্নিতকরণের জন্য নির্জীবাণু পন্থায় কানে ট্যাগ নম্বর (tag number) লাগাতে হয়। এটা ছোট আকারের পারিবারিক খামারে প্রয়োজন না হলেও বড় খামারে খুবই প্রয়োজন। পশুর জাত উন্নয়ন বা অন্য কোনো গবেষণা কাজে প্রতিটি গবাদিপশুর আলাদা তথ্য সংগ্রহ করা অত্যাবশ্যক। এজন্য বাছুরের মাতা-পিতা অনুসারে চিহ্নিতকরণ খুবই প্রয়োজন। সীসার পাতে নম্বর থাকে যা বাছুরের কানে একটি বিশেষ যত্রের সাহায্যে পরিয়ে দেয়া হয়।

৩) পরিমিত খাদ্য পরিবেশন, মলমূত্র ও বিছানা পরিষ্কার করা :

বাছুর প্রতিপালনে দৈনিক পরিমিত খাদ্য পরিবেশনের কোনো বিকল্প নেই। বর্ধিষ্ণু বাছুরের চাহিদা অনুসারে জন্ম থেকে  স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত খাদ্যতালিকা অনুসারে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।তাছাড়া স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রতিপালনের জন্য বাছুরের শয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘরটিতে মলমূত্র নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেননা মলমূত্র থেকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং এতে বাছুর
কৃমিসহ নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। যে বিছানা বাছুরের ঘরে বা খোপে দেয়া হয় তাও মাঝে মধ্যে পরিষ্কার করে শুকনো রাখতে হবে। স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থায় এদের নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। এতে কাফ স্কাউর রোগেরও সৃষ্টি হতে পারে।

৪) বাছুর সময়মতো খোপে ওঠানো ও নামানো :

বাছুরের খোপে এদেরকে নিয়মিত ওঠানামা করাতে হয়। সারাদিন খোপে আবদ্ধ রাখা যেমন ঠিক নয়, তেমনি দিনভর খোলা জায়গায় বিচরন করতে দেয়াও উচিত নয় । এটা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত মৌসুম নির্বিশেষে করা প্রয়োজন। বৃষ্টিতে ভেজা বা অতিরিক্ত ঠান্ডায় থাকলে বাছুরের ফুসফুস প্রদাহ রোগ হতে পারে ।

 

বাসস্থান ও পরিচর্যা

 

৫) বাছুরের প্রাত্যহিক পর্যবেক্ষণ ও রোগচিকিৎসা :

প্রাত্যহিক পর্যবেক্ষণ ও রোগব্যাধিতে নিয়মিত ওষুধ সেবন বাছুর পরিচর্যার অন্যতম করনীয় কাজ। তাছাড়া সময় সময় দৈহিক বৃদ্ধির তথ্য বা অবনতির পরিমাপ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। জন্ম থেকে মাসিকভিত্তিতে দৈনিক ওজন পরিমাপ করা পশু পরিচর্যার এক নিয়মমাফিক কাজ। এই কাজটি গ্রামীণ পারিবারিক খামারে সম্ভব না হলেও বৃহদাকার গরুর খামারে অত্যাবশ্যক কাজ হিসেবেই বিবেচিত। দৈহিক বৃদ্ধি বা ওজন তথ্য বাছুরের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তের পরিচায়ক ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment