আমাদের আজকের আর্টিকেলটি মহিষের খাদ্য সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৭ এর অন্তর্ভুক্ত |
মহিষের খাদ্য
মহিষ থেকে পর্যাপ্ত দুধ, মাংস, শক্তি ইত্যাদি পেতে হলে অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় এদেরকেও পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য প্রদান করতে হবে। অন্যান্য রোমন্থক প্রাণী, যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির মতো মহিষের পাকস্থলীও চারটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। মহিষ পালনের অন্যতম সুবিধা হলো এরা গরুর তুলনায় অতি নিম্নমানের খাদ্য খেয়েও সহজে হজম করতে পারে এবং তুলনামূলকভাবে বেশি উৎপাদন দিয়ে থাকে। এদেশের বেশির ভাগ মহিষই রাস্তার পাশের ঘাস, ধানের খড় এবং কোনো কোনো সময় সামান্য খৈল বা ভুশি খেয়ে জীবনধারণ করে। এসব খাদ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাদ্য উপাদানগুলো উপযুক্ত পরিমাণে থাকে না ।
খাদ্য (Feed stuffs )
মহিষের দেহরক্ষা, ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধি, তাপ সংরক্ষণ ও পেশির শক্তি উৎপাদন, দুধ উৎপাদন এবং বংশবৃদ্ধির জন্য খাদ্যের প্রয়োজন হয়। অন্যান্য গবাদিপশুর ন্যায় মহিষের প্রধান খাদ্যসমূহও উদ্ভিদজাত । এগুলোকে গরু বা ছাগলের খাদ্যের ন্যায় তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ক. আঁশযুক্ত খাদ্য, খ. দানাদার খাদ্য ও গ. খাদ্য অনুসঙ্গ বা অ্যাডিটিভস্ । শুষ্ক আঁশযুক্ত খাদ্যসমূহ, যেমন- বিভিন্ন শস্যের খড় এবং তাজা ঘাস, যেমন- নেপিয়ার, প্যারা, জোয়ার প্রভৃতি মহিষের খাদ্যের প্রধান উৎস।
তবে, বিভিন্ন প্রকার লিগিউম বা ডালজাতীয় তাজা আঁশযুক্ত খাদ্য, যেমন- মটর, খেসারি, কলাই ইত্যাদিও অনেক সময় মহিষকে খেতে দেয়া হয়। দানাদার খাদ্যের মধ্যে চালের কুঁড়া, গমের ভুশি, ভুট্টা, যব, চাল, বিভিন্ন ধরনের খৈল, যেমন- সরিষা, তিসি, তিল, বাদাম ইত্যাদির খৈল এবং বিভিন্ন ধরনের লিগিউমের বীজ, যেমন- বুট, মটর, কলাই, খেসারি ইত্যাদি প্রধান। এছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফিড অ্যাডিটিভস্ বাজারে পাওয়া যায়।
মহিষের পাকস্থলী
গরু, ভেড়া ও ছাগলের মতো মহিষের পাকস্থলীও জটিল ধরনের এবং রুমেন, রেটিকুলাম, ওমেসাম ও অ্যাবোমেসাম নামক চারটি প্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত। খাদ্যনালীর পরেই রুমেনের অবস্থান এবং আয়তনের দিক থেকে পাকস্থলীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ। জন্মের সময় বাছুরের রুমেন খুব ছোট ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। বাছুরের বয়স তিনমাস হলেই রুমেন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং খাদ্য পরিপাক করতে শুরু করে। এসময় মহিষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় কিছু কিছু করে আঁশযুক্ত খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করলে রুমেনের গঠন ত্বরান্বিত হয়।
বাছুরের জন্মের সাত সপ্তাহের মধ্যে রুমেন ও রেটিকুলামের গঠন সম্পূর্ণ হয়। জন্মের সময় মহিষ বাছুরের রুমেনের আয়তন ১.৩ লিটার থাকে এবং ১৬ সপ্তাহ বয়সে তা ২০.৯৫ লিটারে পৌঁছে। অন্যদিকে, রেটিকুলাম ও ওমেসামের আয়তন জন্মের সময় যথাক্রমে ৬৯ ও ৩৪ মি.লি. এবং ১৬ সপ্তাহ বয়সে যথাক্রমে ৮০০ ও ৯৫০ মি.লি. হয়।
মহিষ তার রুমেনমধ্যস্থিত অনুজীব ও এককোষী প্রাণীর সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের অ-আমিষ নাইট্রোজেনজাতীয় খাদ্য এবং সেলুলোজযুক্ত শুকনো খড়জাতীয় খাদ্য থেকে যথাক্রমে উঁচুমানের আমিষ ও শর্করা সংশ্লেষণ করতে সক্ষম। মহিষের রসদের মোট আমিষের এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়ার সাহায্যে প্রতিস্থাপন করে এবং ইউরিয়া, চিটাগুড়সহকারে দানাদার খাদ্য মিশ্রিত করে খাওয়ালে এদের রুমেনের অনুজীব ও এককোষী প্রাণীর সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পায়। ফলে এদের মাধ্যমে রুমেনমধ্যস্থ খাদ্যবস্তু ভাঙ্গার হার ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সংশ্লেষণের হার বাড়ে।
মহিষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য
মহিষের খাদ্যতালিকা বা রসদ অবশ্যই সুষম হতে হবে। এতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, যেমন- শ্বেতসার, আমিষ ও স্নেহপদার্থ শরীর রক্ষা ও উৎপাদনের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ ও হারে থাকা অপরিহার্য। রসদের তালিকাভুক্ত খাদ্যদ্রব্যগুলো পুষ্টিকর হওয়ার পাশাপাশি যেন সুস্বাদু হয় তা লক্ষ্য রাখতে হবে। মহিষের জন্য আঁশযুক্ত খাদ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই খাদ্য দেহে কর্মশক্তি যোগায়। এদের রসদে তাজা আঁশযুক্ত খাদ্য দিতে হয়। কারণ, এই খাদ্য থেকেই এরা প্রয়োজনীয় খণিজপদার্থ, যেমন- ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস এবং ভিটামিনসমূহ, যেমন- ভিটামিন-ই ও ভিটামিন-এ সংগ্রহ করে নিতে পারে।
একটি মহিষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো অল্প পরিমাণ খাদ্যের মাধ্যমেও সরবরাহ করা যায়। কিন্তু তা মহিষের ক্ষুধা নিবারণের জন্য যথেষ্ট হয় না। এদের শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য খাদ্যমানের সঙ্গে খাদ্যের সঠিক আয়তনও প্রয়োজন ।আঁশযুক্ত খাদ্য মহিষের খাদ্যকে আয়তনসম্পন্ন করে তোলে। খাদ্যতালিকাভুক্ত উপাদানগুলো যেন সহজলভ্য ও সস্তা হয় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।
মহিষের দৈহিক ওজন এবং উৎপাদন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শুষ্কপদার্থের প্রয়োজনীয়তার তারতম্য হয়ে থাকে। সাধারণত একটি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের মহিষের জন্য ২.৫-৩.০ কেজি শুষ্ক পদার্থের প্রয়োজন হয়। এ পরিমাণ শুষ্কপদার্থ আঁশযুক্ত ও দানাদার খাদ্য থেকে পেতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো অবশ্যই ঐ খাদ্যসমূহে থাকতে হবে। এজন্য মহিষের জন্য প্রয়োজনীয় শুষ্কপদার্থের দুই-তৃতীয়াংশ আঁশযুক্ত খাদ্য এবং এক-তৃতীয়াংশ দানাদার খাদ্য থেকে সরবরাহ করা উচিত। আবার আঁশযুক্ত খাদ্যের দুই-তৃতীয়াংশ শুষ্ক আঁশযুক্ত এবং এক-তৃতীয়াংশ তাজা আঁশযুক্ত হওয়া উচিত। তবে, কাঁচা ঘাস দিতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
মহিষের খাদ্যতালিকা
বাছুরের খাদ্যতালিকা
জন্মের পর মহিষের বাচ্চার রুমেন অপরিপক্ক থাকে, তাই এসময় বিশেষভাবে তৈরি খাদ্য খাওয়াতে হবে। বাছুরকে শালদুধ, দুধ, টানা দুধ (skim milk), বিকল্প দুধ ও প্রাথমিক খাদ্য (calf starter) প্রভৃতি খাওয়ানো হয়। তবে, কিছু কিছু উন্নতমানের তাজা বা শুষ্ক ঘাস খাওয়ানো হয় যাতে এর রুমেনের গঠন ত্বরান্বিত হয়। সারণি ৩২-এ ৩ মাস বয়স পর্যন্ত বাছুরের খাদ্যতালিকা দেখানো হয়েছে।
সারণি ৩২ : জন্মের দিন থেকে তিন মাস বয়স পর্যন্ত বাছুরের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা
প্রাথমিক খাদ্য
এটি অল্পবয়স্ক বাছুরকে খাওয়ানোর জন্য এক ধরনের দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ। এতে ২০-২৩% পরিপাচ্য আমিষ ও ৭০-৭৩% সামগ্রিক পরিপাচ্য পুষ্টি (TDN ) বিদ্যমান। সারণি ৩৩-এ একটি প্রাথমিক খাদ্যতালিকার নমুনা দেখানো হয়েছে।
সারণি ৩৩ : বাছুরের জন্য প্রাথমিক খাদ্য তালিকা
বকনা মহিষের খাদ্যতালিকা
৩-৬ মাস পর্যন্ত বকনা মহিষের জন্য – দৈনিক ১০-১২ কেজি সবুজ যব/ভুট্টা/সংরক্ষিত সবুজ ঘাস ও ১.২-১.৫ কেজি দানাদার খাদ্য অথবা ৩ কেজি সবুজ ঘাস, ২ কেজি খড় ও ১.৪-২.০ কেজি দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। ৬-১২ মাস বয়সের বকনার জন্য- দৈনিক ২০-২৫ কেজি সবুজ যব/ভুট্টা ও ১.২৫ কেজি দানাদার খাদ্য অথবা ৫ কেজি সবুজ ঘাস, ৩ কেজি খড় ও ২ কেজি দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
১ বছর থেকে গর্ভধারণের সময় পর্যন্ত বকনার খাদ্যতালিকা – দৈনিক ৩০-৩৫ কেজি সবুজ যব/ভুট্টা ও ২ কেজি দানাদার খাদ্য অথবা ৩০ কেজি খেসারি/কাউপি, ৩ কেজি খড় ও ১ কেজি দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
দুগ্ধবতী মহিষের খাদ্যতালিকা
দুগ্ধবতী মহিষকে খাদ্য প্রদানের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীররক্ষা ও উৎপাদনে সহায়তা করা। উদাহরণস্বরূপ, ৭% হেপদার্থযুক্ত দৈনিক ১০ লিটার দুধ উৎপাদনকারী একটি ৫০০ কেজি ওজনের মহিষের খাদ্যে ১২.৫-১৫.০ কেজি শুষ্ক পদার্থ, ০.৯৩ কেজি পরিপাচ্য আমিষ ও ৮.৩ কেজি সামগ্রিক পরিপাচ্য পুষ্টি (TDN) থাকতে হবে। এই পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যেতে পারে দৈনিক ৬০ কেজি সবুজ বারসিম ও ৫.৫ কেজি গমের খড় বা ২০ কেজি সুবজ যব/ভুট্টা, ৫ কেজি গমের খড় ও ৪ কেজি দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ থেকে ।
ষাঁড়ের খাদ্যতালিকা
ষাঁড়কে সবল ও সক্রিয় রাখার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য না খাওয়ানোই ভালো। ভালো জাতের সবুজ ঘাস ও খড় খাওয়ানোর মাধ্যমেই ষাঁড়কে সুস্থ রাখা সম্ভব; এজন্য কোনো দানাদার খাদ্যের প্রয়োজন নেই। ৬০০ কেজি ওজনের একটি ষাঁড়ের জন্য দৈনিক ৪০-৫০ কেজি সবুজ ঘাস ও ২-৩ কেজি খড় এবং ২.০-৩.০ কেজি দানাদার খাদ্যই যথেষ্ট।
আরও দেখুনঃ