আমাদের আজকের আর্টিকেলটি গাভীর বাসস্থান ও পরিচর্যা সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৫ এর অন্তর্ভুক্ত |
গাভীর বাসস্থান ও পরিচর্যা
গাভীর বাসস্থান
গাভীর বাসস্থানকে গোশালা বলে। এদেশে গোয়াল ঘরও বলা হয়। আর যারা গাভী পালন করে দুধের ব্যবসা করেন তাদেরকে গোয়ালা বলে। কাজেই গোয়াল ঘর বা গোশালা, গোয়ালা ও দুধের মধ্যে একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। এখানে গাভী হচ্ছে কেন্দ্রিক জীবন্ত বস্তু। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দু’টি পন্থায় গাভী পালন করা হয়, যথা- ১. চারনভূমিতে গরু চরানোর মাধ্যমে ও ২. গোশালায় বেঁধে রেখে খাদ্য পরিবেশন ও মলম ত্র নিষ্কাশনের মাধ্যমে। আমাদের দেশে এর কোনোটিই বিকশিত হয়নি। এজন্য গোশালা বা গোয়াল ঘরে গাভী প্রতিপালনই এদেশে গাভী পালনের পদ্ধতি হিসেবে সমাদ্রিত।
এ গোশালা বাড়ির অনতিদ রে (৪৫-৬০ মিটার) একটি উঁচু জায়গায় নির্মাণ করা শ্রেয়, যাতে দুর্গন্ধ ও গরুর মলমূত্র থেকে মানুষের সমস্যা সৃষ্টি না হয়। গোশালার জায়গা নির্বাচনে চারটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন, যথা- ১. যথাযথ নর্দমা ও পয়ঃপ্রনালীর ব্যবস্থা, ২. লোকালয় থেকে দূরে স্থাপন করা ৩. উত্তরদক্ষিণমুখী হওয়া ও ৪. চারনভূমির সুবিধা বা গাভী বাইরে আনা-নেয়ার সুবিধা থাকা। এরপর গোশালা নির্মাণে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। যথা-
- শুষ্ক পরিবেশ ও আবহাওয়ায় গোশালা তৈরি করতে হবে। গোশালার মেঝে যে দ্রব্যসামগ্রী দিয়েই তৈরি করা হোক না কেন তা অবশ্যই শুষ্ক রাখতে হবে।
- গোশালাটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে সহজেই প্রচুর আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে এবং তাপ, আর্দ্রতা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- গোশালা কোনোক্রমেই স্যাঁতস্যাঁতে হওয়া চলবে না। এতে গাভীর বিভিন্ন পরজীবী বা জীবাণুঘটিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ।
- গোশালা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে না পারে।
- গোশালাটি মজবুত ও আরামদায়ক হওয়া চাই। বিশ্রাম ও ব্যায়াম করার জন্য গোশালায় প্রয়োজনীয় জায়গার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- গোশালা যেন সহজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা যায় এবং পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা থাকে ।
- গোশালা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা গাভীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয় ।
অতএব, গাভীর বাসস্থান তৈরির মূলে থাকছে গাভীর নিরাপত্তা ও দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে আত্নরক্ষামূলক ব্যবস্থা। একই সাথে খাদ্য পরিবেশন, মলমূত্র নিষ্কাশন, আরাম-আয়েস, যত্ন ও পরিচর্যার সবরকম ব্যবস্থা । গোশালার উচ্চতা ২.৭৫-৩.০ মিটার (৯-১০ ফুট) হতে হবে। খাদ্য পরিবেশনের জন্য চাড়ি বা গামলা ও পানির পাত্র গোশালায় থাকতে হবে। প্রতিটি চাড়ি বা গামলা ও পানির পাত্রের পরিসর হবে যথাক্রমে ১.০ মিটার × ১.২ মিটার (৪০ ইঞ্চি x ৪৮ ইঞ্চি) ও ০.৩ মিটার x ০.৬ মিটার (১২ ইঞ্চিx ২৪ ইঞ্চি)।
গোশালার প্রতিটি গাভীর জন্য আড়পাতা (chute) থাকে যেখানে গাভী বেঁধে রাখতে হয়। খাবারের চাড়ি পাকা কনক্রিট ও আড়পাতা মসৃণ লোহার রড বা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়। মেঝে যাতে পিচ্ছিল না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে তৈরি করতে হয়। প্রতিটি গাভীর জন্য ৫ বর্গ মিটার জায়গাই যথেষ্ট। আবার বড় দুগ্ধ খামারগুলোতে দু’সারিতে গাভী পালন করা হয়। এখানে দু’ভাবে গাভী রাখা হয়, যেমন- মুখোমুখি ও বিপরীতমুখি করে। মুখোমুখি পালনের ক্ষেত্রে ঘর ১১ মিটার (৩৬ ফুট) প্রশস্থ হবে এবং বিপরীতমুখি পালনের ক্ষেত্রে ঘর ১০.৪ মিটার (৩৪ ফুট) প্রশস্থ হবে।
গাভীর পরিচর্যা
গাভী পরিচর্যার লক্ষ্য হলো গাভী যাতে সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যবতী ও কর্মক্ষম থাকে সে ব্যবস্থা করা। গাভী পরিচর্যার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে। যথা-
- স্বাস্থ্য ও আচরণসংক্রান্ত পরিচর্যা,
- সাধারণ বদঅভ্যাস বা দোষত্রুটি নিরাময়সংক্রান্ত পরিচর্যা,
- প্রজনন ও প্রসবসংক্রান্ত পরিচর্যা,
- দোহনকালের পরিচর্যা ইত্যাদি।
১) স্বাস্থ্য ও আচরণসংক্রান্ত পরিচর্যা :
স্বাস্থ্য ও আচরণসংক্রান্ত পরিচর্যা বলতে সাধারণ স্বাস্থ্যের উপর শুভ প্রতিক্রিয়া করে এমন ধরনের কর্মকান্ড সম্পাদনকে বুঝায়। যেমন- গাভীর শরীর আচড়ানো (grooming), ব্যায়াম, খুর কাটা, শিং সাজানো ও শিংছেদন (dehorning) ইত্যাদি। এসব পরিচর্যায় গাভীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং উৎপাদনে শুভ প্রভাব পড়ে।
২) সাধারণ বদঅভ্যাস বা দোষত্রুটি নিরাময় :
কোনো কোনো গাভীর মধ্যে দুধ দোহনের সময় দোহনকারিকে লাথি মারা, নিজের বাট চোষা বা ঘরের বেড়া ভাঙ্গা প্রভৃতি বদঅভ্যাস দেখা যায়। একবার এসব বদঅভ্যাস কোনো গাভীকে পেয়ে বসলে তা ঠিক করা বেশ কঠিন। তবে, উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে কিছু দোষত্রুটি নিরাময় করা সম্ভব। যেমন- দুধ দোহনের সময় লাথি মারা সাধারণত প্রথমবার বাচ্চা দেয়া বা নবীন গাভীর ( heifer) বেলায় দেখা যায়। এক্ষেত্রে গাভীর লাথি মারার প্রকৃত কারণ জেনে সে অনুযায়ী তা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
কারণ না জেনে আন্দাজের ওপর প্রতিকারের ব্যাবস্থা নিলে গাভীর মধ্যে এটি সব সময়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। তখন সে গাভীর দুধ দোহনের জন্য শিকল বা রশি দিয়ে তার দুপা বাধা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এই রকম আরও যেসব বদঅভ্যাসের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো নিরাময়ের কিছু পন্থা উদ্ভাবন করা যেতে পারে। যেমন- বাট চোষনের বেলায় শিকল বা ষাঁড়ের নাকে পরানোর আংটি গাভীর নাকে পরিয়ে দেয়া যায় অথবা কাঁটাযুক্ত ঠোনা (muzzle strap) বা ঠুলি চাপিয়ে দিলে গাভী বাট চুষতে পারে না। বেড়া ভাঙ্গার অভ্যাস নিরাময় কঠিন, তবে আক্রমণাত্বক দোষযুক্ত হলে গাভীর নাকে শক্ত হাতে ঘুষি মারা যেতে পারে।
৩) প্রজনন ও প্রসবসংক্রান্ত পরিচর্যা :
গাভীর প্রজনন ও প্রসবসংক্রান্ত পরিচর্যা করতে হলে এদের শারীরতত্ত্বের জ্ঞান থাকা আবশ্যক। গাভীর গর্ভধারণকাল ও ঋতুচক্রের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ২৮১°৫ ও ২১+৩ দিন। বাচ্চা প্রসবের ৭৫-১১০ দিনের মধ্যে গাভীকে পাল দেয়ানো উচিত। প্রসব ও পরবর্তী গর্ভধারণের মধ্যে ৬০ দিনের বেশি ছাড় দেয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা এ সময়ের মধ্যে জরায়ু স্বাভাবিক হয়ে যায়। এসব বিষয় বিরেচনা করে গাভীর পরিচর্যা করতে হবে। এতে গাভীর দুধ উৎপাদন সঠিক হবে। কোনো গাভীকে একবার গর্ভধারণ করাতে যে সংখ্যক পাল দিতে হয় সে সংখ্যা দিয়ে তার প্রজনন দক্ষতা (breeding efficiency) যাচাই করা হয়।
গর্ভধারণ ও প্রসবকালে গাভীকে সঠিকভাবে যত্ন ও পরিচর্যা করতে হয়। এই সময় অবহেলা ও অবজ্ঞা করলে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে; তাছাড়া গাভীর প্রজনন ও গর্ভধারণ ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রসবকাল যতই অগ্রসর হয় ততই গাভীর বহিঃযৌনাঙ্গের চামড়া মসৃণ হয়ে ওঠে। লেজের দুপাশের লিগামেন্ট অবসন্ন হয়ে পড়ে ও ওলান ফুলে ওঠে। গাভীর মধ্যে অস্থির ভাব দেখা যায়। এই সময় গাভীকে নিকটস্থ পশু হাসপাতালে নিয়ে ভেটেরিনারি সার্জনের সাহায্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়।
গাভীকে রেচক খাবার ( laxative feed), যেমন- ভুশি ও খৈল খেতে দিতে হয়। প্রসবের প্রথম লক্ষণ দেখা দিলেই গাভীকে শান্ত রেখে পর্যবেক্ষণ করা উচিত যাতে প্রাকৃতিকভাবে প্রসব কাজটি নির্বিঘ্নে হতে পারে। যদি ২/৩ ঘন্টা পর প্রসব প্রক্রিয়া আর অগ্রসর না হয় তাহলে নিকটস্থ ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শ নিতে হবে। এ সময় জরায়ুতে বাছুরের অবস্থান নিরীক্ষণ করা দরকার। যদি সামনের পা দু’টো ও মাথার অবস্থান সামনের দিকে না হয় তাহলে ভেটেরিনারি সার্জনের সহায়তা নেয়া অপরিহার্য। বাছুর ভূমিষ্ট হলে ২/৩ দিন গাভীর সাথে ছেড়ে দেয়াই উত্তম।
প্রতিটি পর্যায়ে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বাছুর ও গাভী কোনো দুর্বিপাকে না পড়ে। বাছুর প্রসবের পর গাভীকে খাবার ও ঈষদুষ্ণ পরিষ্কার পানি পরিবেশন করতে হবে। এরপর ২/৩ দিন রেচক খাবার পরিবেশন বাঞ্ছনীয়। গাভীর গর্ভফুল (placenta) না পড়া পর্যন্ত সযত্ন দৃষ্টি রাখতে হবে। বাছুরের নাভি নির্জীবাণু পন্থায় কাটা প্রয়োজন। বাচ্চা প্রসবের পর গাভীর ওজন কমে যায়। বেশি খাবার পরিবেশন করে ও সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে তা পুষিয়ে দিতে হবে।
৪) দুগ্ধ দোহনকালের পরিচর্যা :
দুগ্ধ দোহন নিজেই একটি অতিসংবেদনশীল প্রক্রিয়া। দোহনের মূল লক্ষ্য হলো এমনভাবে দোহন করতে হবে যাতে ওলান থেকে সম্পূর্ণ দুধ টেনে বের করে আনা যায়। ওলান থেকে দুধ ছেড়ে দেয়া (let down ) একটি প্রতিবর্ত ক্রিয়া যা সম্পূর্ণ দোহনে অত্যাবশ্যক । সুতরাং সকল প্রকার ভিতিপ্রদ ও নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ থেকে গাভীকে মুক্ত রাখতে হবে। দুধ দোহনের সময় দু’টো অত্যাবশ্যক কাজ সম্পাদন করতে হবে, যথা- ১. অযথা গাভীকে উত্তেজিত করা থেকে বিরত থাকা ও ২. দ্রুততার সাথে দোহনকাজ শেষ করা।
দুধ দোহনকালে গাভীকে সম্পূর্ণ শান্ত ও সুস্থির রাখতে হবে। এই সময় মশামাছি উৎপাত করলে গাভীর দোহন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে। গাভী পরিচর্যার আর একটি লক্ষ্য হচ্ছে গাভীকে পোকামাকড় ও মশামাছি থেকে নিরাপদ দুরত্বে রাখা। তাছাড়া গাভীর পেটে যাতে কৃমির ডিম প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য খাদ্য পরিবেশনে সদাসতর্ক থাকতে হবে।
আরও দেখুনঃ