আমাদের আজকের আর্টিকেলটি ছাগলের খাদ্য সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৬ এর অন্তর্ভুক্ত |
ছাগলের খাদ্য
ছাগলের খাদ্যাভ্যাস
ছাগল অনুসন্ধিৎসু প্রাণী। খাদ্যের সন্ধানে এরা বহুদ র পর্যন্ত যেতে পারে। এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস এদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে বেশ সহায়তা করে। এরা অত্যন্ত কষ্ট সহ্য করতে পারে। প্রচন্ড খরার মধ্যেও অনেকক্ষণ পানি ছাড়া থাকতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা খাদ্য ঘাটতির সময় অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে যা সচরাচর অন্যান্য গৃহপালিত পশু খায় না।
তৃণভোজী পশুদের মধ্যে ছাগলের মুখ অত্যধিক শক্ত। এরা এদের সচল উপরের ঠোঁট (mobile upper lip) ও পরিগ্রাহী জিহ্বার (prehensile tongue) সাহায্যে অনায়াসে ছোট ছোট ঘাস, বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা, সুরক্ষিত কাঁটা ঝোপ, গাছের শাখাপ্রশাখা ইত্যাদি টেনে ছিড়ে খেতে পারে। এরা যা খায় তা একেবারে মুড়ে খায়। ছাগল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে খাদ্যসামগ্রীকে পরিপূর্ণভাবে উৎপাদনসামগ্রীতে পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
ছাগল নানা ধরনের খাদ্যবস্তু খেতে পছন্দ করলেও সব সময় একই ধরনের খাবার খেতে চায় না। তাই এদের খাদ্যে বৈচিত্র থাকা উচিত। কোনো একটি ছাগলের উচ্ছিষ্ট খাদ্য সাধারণত অন্য ছাগল খেতে চায় না।
এরা খাদ্যের তারতম্য অর্থাৎ তিতা, মিষ্টি, টক, নোন্তা ইত্যাদি বুঝতে পারে। এদের খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানগুলো মাঝে মাঝে বদলে দেয়া উচিত। তবে, লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এতে খাদ্যমধ্যস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানগুলোর সুষমতার হেরফের না ঘটে ছাগলের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের পরিমাণ জানার আগে তার খাদ্য পরিপাক যন্ত্র অর্থাৎ পাকস্থলী (stomach) সম্পর্কে একটু জ্ঞান রাখা দরকার।
ছাগল গরু, মহিষ ও ভেড়ার মতোই রোমন্থক (ruminant) প্রাণী। রোমন্থক প্রাণীর বৈশিষ্ট্য হলো এরা ঘাস, লতাপাতা অর্থাৎ তৃণজাতীয় খাদ্যবস্তু ভালোভাবে না চিবিয়ে প্রথমে গিলে ফেলে এবং ক্ষুধা মেটানোর জন্য চাহিদা মোতাবেক যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি খেতে চেষ্টা করে। পরে নিরিবিলি কোনো স্থানে আরাম করে অল্প চিবানো গিলিত খাদ্য পুনরায় মুখে ফেরত নিয়ে আসে এবং ভালোভাবে চিবাতে থাকে। এরপর ভালো করে চিবানো খাদ্য পুনরায় পাকস্থলীতে প্রবেশ করে ও চারটি প্রকোষ্ঠ ঘুরে অবশেষে ক্ষুদ্রান্ত্রে চলে যায়।
এই অদ্ভুত প্রক্রিয়াকে রোমন্থন ক্রিয়া (rumination) বা গিলিত চর্বন কাজ বলা হয় । অন্যান্য রোমন্থক প্রাণীর মতোই ছাগলের পাকস্থলীও চারটি জটিল প্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত। যেমন- ১. প্রথম প্রকোষ্ঠ বা রুমেন (rumen), ২. দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ বা রেটিকুলাম (reticulum), ৩. তৃতীয় প্রকোষ্ঠ বা ওমেসাম (omasum) ও ৪. চতুর্থ প্রকোষ্ঠ, প্রকৃত পাকস্থলী বা অ্যাবোমেসাম (abomasum)।
নবজাত বাচ্চা ছাগল যেহেতু দুধের ওপরই নির্ভরশীল তাই এদের পাকস্থলীর চতুর্থ প্রকোষ্ঠটিই সবচেয়ে বড় থাকে। কারণ, দুধের পরিপাক ক্রিয়া মানুষ ও অন্যান্য সরল পাকস্থলীবিশিষ্ট প্রাণীর পাকস্থলীর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ চতুর্থ পাকস্থলীতেই ঘটে থাকে। বাচ্চা ছাগলের অ্যাবোমেসাম তার পুরো পাকস্থলীর প্রায় ৭০% জায়গা জুড়ে থাকে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার ঘাস, লতাপাতা অর্থাৎ কঠিন খাদ্যবস্তু খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে ও দুধের ওপর নির্ভরশীলতা কমতে থাকে। ফলে পাকস্থলীর অন্যান্য অংশ (বিশেষ করে প্রথম প্রকোষ্ঠ বা রুমেন) ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অ্যাবোমেসাম ছোট হতে থাকে। ২.৫-৩.০ মাস বয়সে বাচ্চা যখন দুধ পান করা একেবারেই ছেড়ে দেয় এবং পুরোপুরি ঘাস, লতাপাতা ও দানাদার খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখন পাকস্থলীর বৃদ্ধি সম্পর্ণ হয়ে যায়। রুমেন পুরো পাকস্থলীর প্রায় ৮০%-এ দাড়ায়। আর অ্যাবোমেসাম ৭-৮%-এ নেমে আসে। রেটিকুলাম এবং ওমেসাম যথাক্রমে ৭-৮% ও ৫% হয়।
ছাগলের খাদ্যের শ্রেণিবিন্যাস
অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতোই ছাগলের খাদ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণে আমিষ, শর্করা, চর্বি, খণিজ পদার্থ ও ভিটামিন থাকতে হবে। এদেশের অনেকের মধ্যেই একটি ধারণা রয়েছে যে, ছাগল পানি পান করে না। এই ধারণাটি সঠিক নয়। ছাগল যাতে প্রয়োজনীয় পানি পান করতে পারে অবশ্যই তার ব্যবস্থা করতে হবে।
খাদ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী ছাগলের খাদ্যকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ১. আঁশজাতীয় খাদ্য, ২. দানাদার খাদ্য ও ৩. ফিড অ্যাডিটিভস্ ।
১. আঁশজাতীয় খাদ্য (Roughages) :
এজাতীয় খাদ্যে হজমযোগ্য দ্রব্য কম থাকে। আঁশের (fibre) পরিমাণ ১৮%-এর বেশি এবং মোট পরিপাকযোগ্য পুষ্টি উপাদান (total digestible nutrient or TDN) ৬০%-এর কম থাকে। আঁশজাতীয় খাদ্য দুধরনের। যেমন- ক. শুষ্ক আঁশজাতীয় খাদ্য (dry roughages) এবং খ. সরস বা রসালো আঁশজাতীয় খাদ্য (succulent roughages)।
রসালো আঁশজাতীয় খাদ্যে পানির পরিমাণ ৭৫-৯৫% থাকে। আঁশজাতীয় খাদ্যের উৎস হলো বিভিন্ন ধরনের তাজা ঘাস, যেমন- দূর্বা, ভুট্টা, নেপিয়ার ইত্যাদি; বিভিন্ন ধরনের পাতা, যেমন- কাঁঠাল, আম, পেয়ারা ইত্যাদি; বিভিন্ন ধরনের শাকশবজি, যেমন- বাঁধাকপি, বরবটি, মাটি কলাই ইত্যাদি; বিভিন্ন ধরনের লতাগুল্ম, খড় প্রভৃতি। জটিল পাকস্থলীসম্পন্ন (compound stomach) ছাগল আঁশজাতীয় খাদ্য থেকে সহজেই অধিক পরিমাণে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে যা সরল পাকস্থলীসম্পন্ন প্রাণীরা পারে না ।
২. দানাদার খাদ্য (Concentrates) :
দানাদার খাদ্য বা খাদ্য মিশ্রণ সুপাচ্য ও পুষ্টিকর উপাদানে (যেমন- আমিষ, শর্করা, চর্বি) সমৃদ্ধ। এই শ্রেণীর খাদ্যে পানির পরিমাণ কম, আঁশের পরিমাণ ১৮%- এর কম এবং মোট পরিপাকযোগ্য পুষ্টি উপাদান বা টি.ডি.এন.-এর পরিমাণ ৬০%-এর বেশি থাকে । দানাদার খাদ্যের উৎস হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, যেমন- বুট, ডাল, গম, মটর, ভুট্টা, চাল, খেসারি ইত্যাদি; মূল ও কন্দজাতীয় খাদ্য, যেমন- গোল আলু, মিষ্টি আলু, শিমুল আলু ইত্যাদি; বিভিন্ন ধরনের খৈল, যেমন- তিলের খৈল, সরিষার খৈল ইত্যাদি, নালি গুড়, কৃষি শিল্পের উপজাত প্রভৃতি ।
৩. ফিড অ্যাডিটিভস্ (Feed additives) :
খাদ্যকে সুষম করার জন্য অল্প পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খণিজপদার্থের পূর্বমিশ্র বা প্রিমিক্স (premix) হিসেবে এটি দানাদার খাদ্যে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার শাকশবজি থেকেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খণিজ পদার্থ পাওয়া যায়।
আঁশজাতীয় খাদ্য খেয়ে শুধু জীবনধারণ করা যায়। কিন্তু ছাগল থেকে মাংস, দুধ, চামড়া, লোম বা পশম প্রভৃতির ভালো উৎপাদন পেতে হলে খাদ্যতালিকায় আঁশজাতীয় খাদ্যের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ থাকতে হবে। সাধারণত এক ধরনের দানাদার খাদ্যের পরিবর্তে একসঙ্গে বিভিন্ন উপকরণ (ingredients) একত্রে মেশালে খাদ্যের স্বাদ ও হজম বৃদ্ধি পায় ।
ছাগলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির পরিমাণ
ছাগলের জন্য বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান বিভিন্ন হারে প্রয়োজন হয়। সারণি ২৮-এ ছাগলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের চাহিদা উল্লেখ করা হয়েছে।
সারণি ২৮ : ছাগলের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের চাহিদা
ছাগলের সুষম খাদ্য তালিকা
সুষম খাদ্য (Balanced ration ) :
যেসব খাদ্য মিশ্রণে পশুদেহের দৈহিক প্রয়োজন মিটানোর জন্য উপযুক্ত পরিমাণে ও অনুপাতে সব রকম পুষ্টিকর উপাদান থাকে সেগুলোকে সুষম খাদ্য বলে। প্রতিটি ছাগলের জন্য সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। কারণ খাদ্যে বিভিন্ন উপাদানের সুষমতার অভাব হলে ছাগল তার প্রয়োজন অনুযায়ী পুষ্টিকর উপাদান পায় না। ফলে দেহগঠন ও উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়।
খাদ্যতালিকা, রসদ বা রেশন (Ration) :
ছাগলকে দৈনিক অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় যে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য বা খাদ্যসমষ্টি খেতে দেয়া হয়, তাকে খাদ্যতালিকা, রসদ বা রেশন বলে। সারণি ২৯-এ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পালিত ও বিভিন্ন বয়সের ছাগলের জন্য সুষম খাদ্যতালিকার একটি নমুনা দেখানো হয়েছে।
সারণি ২৯ : উদ্দেশ্য ও বয়সভেদে ছাগলের সুষম খাদ্য তালিকা
দৈহিক ওজন অনুযায়ী ছাগলের খাদ্যের পরিমাণ
ছাগলের দৈহিক ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এদের খাদ্যের চাহিদাও বাড়ে। তাছাড়া মাংস, দুধ ইত্যাদি উৎপাদনের জন্যও অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। চার সপ্তাহ বয়স থেকেই ছাগলের বাচ্চাকে দানাদার খাদ্য গ্রহণের উপযোগী করে তুলতে হয়। মায়ের দুধের পাশাপাশি বয়সভিত্তিক নির্দিষ্ট তালিকা অনুসারে দানাদার এবং সবুজ ঘাস ও লতাপাতাজাতীয় খাদ্য সরবরাহ করা যেতে পারে। তাছাড়া খাদ্যের সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার পানিও সরবরাহ করতে হবে। সারণি ৩০-এ ওজনভেদে দৈনিক খাদ্য ও পানি সরবরাহের একটি নমুনা দেখানো হয়েছে।
সারণি ৩০ : দৈহিক ওজনভেদে ছাগলের জন্য দৈনিক খাদ্য ও পানির পরিমাণ
আরও দেখুনঃ