আমাদের আজকের আর্টিকেলটি ছাগলের বাসস্থান ও পরিচর্যা সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৬ এর অন্তর্ভুক্ত |
ছাগলের বাসস্থান ও পরিচর্যা
ছাগলের বাসস্থান
অন্যান্য প্রাণীদের মতো ছাগলেরও রাত্রি যাপন, নিরাপত্তা, ঝড়বৃষ্টি, ঠান্ডা, রোদ ইত্যাদির কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাসস্থানের প্রয়োজন রয়েছে। তবে, এদেশের গ্রামাঞ্চলে পারিবারিক পর্যায়ে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে বাসস্থানের জন্য তেমন কোনো আলাদা ব্যবস্থা দেখা যায় না।
গোয়াল ঘর বা গোশালায় গরুমহিষের পাশাপাশি, ঘরের বারান্দা, রান্নাঘর প্রভৃতি স্থানে ছাগলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। অনেকে জায়গা স্বল্পতার জন্য ও নিরাপত্তার কারণে নিজেদের ঘরের ভেতরেই ছাগলের রাত যাপনের ব্যবস্থা করেন। রোগমুক্ত আবহাওয়ায় কেউ কেউ রাতের বেলা এদেরকে নিজেদের ঘরের পাশে গাছের নিচেই বেধে রাখেন। দু’চারটি ছাগল পালনের ক্ষেত্রে এসব ব্যবস্থায় তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু, একসঙ্গে অনেক ছাগল পালন করতে হলে অর্থাৎ খামারে ছাগল পালন করতে হলে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ছাগলের বাসস্থান বা ঘর তৈরি করতে হবে।
ছাগলের বাসস্থান বা ঘর তৈরির পূর্বশর্ত
- শুষ্ক পরিবেশ ও আবহাওয়ায় ঘর তৈরি করতে হবে। ঘরের মেঝে যে দ্রব্যসামগ্রী দিয়েই তৈরি করা হোক না কেন তা অবশ্যই শুষ্ক রাখতে হবে।
- ঘরটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে সহজেই প্রচুর আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে এবং তাপ, আর্দ্রতা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- ঘর কোনোক্রমেই স্যাঁতস্যাঁতে হওয়া চলবে না। এতে বিভিন্ন পরজীবী বা রোগজীবাণুঘটিত
- রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ঘর এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে না পারে। মাটির দেয়ালে আবদ্ধ ঘরে ছাগল পালন করলে তা এদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। তাই দেয়ালের অর্ধেকটা বাঁশের বেড়া বা ইটের গাঁথুনি দিয়ে এবং বাকিটা চট, ত্রিপল প্রভৃতি দিয়ে ঢেকে দিলে শীতের রাতে বা বৃষ্টির সময় এরা ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা পাবে। বৃষ্টি ও ঠান্ডা দুটোই ছাগলের জন্য প্রচন্ড ক্ষতিকর। এতে ছাগলের নিউমোনিয়া (Pneumonia) রোগ হতে পারে ।
- ঘরটি মজবুত ও আরামদায়ক হওয়া চাই। বিশ্রাম ও ব্যায়াম করার জন্য ঘরে প্রয়োজনীয়জায়গার ব্যবস্থা থাকতে হবে ।
- ঘর যেন সহজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা যায় এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকে ।
- ঘর এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা ছাগলের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়।
ছাগলের ঘরের ধরন
ছাগল পালনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঘর রয়েছে। তবে, এদেশে নিম্নে উল্লেখিত দু’ধরনের ঘরই বেশি দেখা যায়। যেমন- ১. ভূমির উপর স্থাপিত ঘর ও ২. খুঁটির উপর স্থাপিত ঘর ।
১. ভূমির উপর স্থাপিত ঘর
এই ধরনের ঘরেই গ্রামের সাধারণ গৃহস্থরা ছাগল পালন করে থাকেন। এই ধরনের ঘরের মেঝে কাঁচা অর্থাৎ মাটি দিয়ে, আধা পাকা অর্থাৎ শুধু ইট বিছিয়ে অথবা সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে তৈরি করা যায়। এই ধরনের ঘরের মেঝেতে শুকনো খড় বিছিয়ে দিলে ভালো হয়। তবে, ঘর সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
২. খুঁটির উপর স্থাপিত ঘর
এই ধরনের ঘর সাধারণত মাটি থেকে ১.০-১.৫ মিটার অর্থাৎ ৩.৩-৪.৯ ফুট উচ্চতায় খুঁটির উপর তৈরি করা হয়। এজাতীয় ঘর ছাগলকে মাটির স্যাঁতস্যাঁতে ভাব, বন্যার পানি, নালা-নর্দমা থেকে চোয়ানো পানি প্রভৃতি থেকে রক্ষা করে। এজাতীয় ঘরের মেঝে বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে মাঁচার মতো করে তৈরি করা হয়। ছাগল পালনে এই ধরনের ঘর অত্যন্ত সুবিধাজনক ।
ছাগলের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা
ছাগলের বয়স এবং আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। সারণি ২৭-এ ছাগলের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ দেখানো হয়েছে। ১.৮ মিটার × ১.৮ মিটার × ১-৩ মিটার অর্থাৎ ৫.৭ ফুট × ৫.৭৫ ফুট × ৩.৩-৯.৮ ফুট আকারের একটি ঘর ১০টি বাচ্চা ছাগলের জন্য যথেষ্ট। প্রতিটি প র্ণবয়স্ক ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জন্য ০.৭৫ মিটার x ৪.৫ মিটার × ৪.৮ মিটার অর্থাৎ ২.৫ ফুট × ১৪.৭৫ ফুট × ১৫.৭৫ ফুট জায়গার প্রয়োজন হয়।
প্রতিটি পাঠার জন্য খোপের মাপ হলো ২.৪ মিটার x ১.৮ মিটার অর্থাৎ ৭.৯ ফুট × ৫.৯ ফুট। গর্ভবতী ছাগলের জন্য আলাদা প্রসূতি কক্ষের ব্যবস্থা থাকা উচিত। খামারে ছাগলের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ঘর ছোট বা বড় করা যাবে। তবে, লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রতিটি ছাগল তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ জায়গা পায়।
সারণি ২৭ : ছাগলের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ
ছাগলের পরিচর্যা
ছাগলকে সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম রাখা এবং ছাগল থেকে সঠিক উৎপাদন পেতে হলে এদেরকে সঠিকভাবে যত্ন বা পরিচর্যা করতে হবে। পরিচর্যা বলতে সময়মতো খাবার পরিবেশন করা, গর্ভবতী ছাগীর যত্ন, অসুস্থ ছাগলকে ওষুধ খাওয়ানো, ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ইত্যাদি বুঝায়। প্রতিটি ছাগলের জন্য সাধারণ পরিচর্যা ছাড়াও গর্ভবতী ছাগী, নবজাত বাচ্চা, প্রজননের পাঠা প্রভৃতির জন্য কিছু বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।
সাধারণ পরিচর্যাসমূহ
ছাগলকে প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের করে খোয়াড়ে (খোয়াড় – দিনের বেলা ছাগল রাখার জন্য বাসস্থানের সঙ্গে লাগোয়া ঘর) কিংবা ঘরের আশেপাশের খোলা জায়গায় চরতে দিতে হবে। এদেরকে ব্যায়াম ও গায়ে সূর্যকিরণ লাগানোর পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান করতে হবে।
- ঘর থেকে ছাগল বের করার পর তা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
- খামারে বেশি ছাগল থাকলে তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য নির্জীবাণু পন্থায় কানে ট্যাগ (tag) নম্বর লাগাতে হয় । এটা ছোট বড় যে কোনো খামারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
- ছাগলকে নিয়মিত সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে। খাবার ও পানির পাত্র পরিষ্কার করে তা খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পূর্ণ করে দিতে হবে। প্রতিটি ছাগলকে আলাদাভাবে দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর খাবার দিতে হবে। সময়ের হেরফের করা যাবে না । পাতাসহ আম-কাঠালের ডাল ঝুলিয়ে সরবরাহ করলে ভালো হয়।
- এরা পানি পছন্দ করে না। তাই নিয়মিত গোছলের পরিবর্তে ব্রাশ দিয়ে ঘষে দেহ পরিষ্কার করতে হবে। এতে লোমের ভিতরের ময়লা বেরিয়ে আসবে এবং রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে। নিয়মিত ব্রাশ করলে লোম উজ্জ্বল দেখাবে ও চামড়ার মান বৃদ্ধি পাবে।
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে দুগ্ধবতী ছাগীর দুধ দোহন করতে হবে। দুধ দোহনের সময় পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
- ঘরের কোনো ছাগল অসুস্থ হলো কিনা তা নিয়মিত লক্ষ্য রাখতে হবে। কোনো ছাগলের মধ্যে অসুস্থতার লক্ষণ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে পৃথক করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
- সকল বয়সের ছাগলকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে ও টিকা প্রদান করতে হবে।
বিশেষ পরিচর্যা
নবজাত বাচ্চা ছাগল, গর্ভবতী ছাগল, প্রজননের পাঠা প্রভৃতির জন্য বিশেষ কিছু পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে। নবজাত বাচ্চার পরিচর্যা বাচ্চা পালন পাঠে আলোচনা করা হয়েছে। আর এখানে গর্ভবতী ছাগী ও পাঠার পরিচর্যা বর্ণনা করা হয়েছে।
গর্ভবতী ছাগীর পরিচর্যা
বাচ্চা পালন অধ্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে এ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে। ছাগীর গর্ভধারণকাল ১৪৫ দিন (প্রায় ৫ মাস)। ছাগীর গর্ভধারণকাল পূর্ণ হওয়ার এক/দুই দিন আগে বা পরে বাচ্চা প্রসবের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। বাচ্চা প্রসব করার অন্তত এক সপ্তাহ পূর্বেই তাকে প্রসূতি ঘরে স্থানান্তর করতে হবে।
গর্ভবতী অবস্থায় ছাগীকে উঁচু মাচায় ওঠতে দেয়া যাবে না। সকালে বাইরে আলাদা খোয়াড়ে বা গাছের নিচে বেধে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রসবের পূর্বে ছাগীর ওলান দুধে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক সময় ওলান খুব বেশি শক্ত হয়ে যায় । তখন দুধ দোহন করা ভালো। তা না হলে ওলানপ্রদাহ বা ম্যাস্টাইটিস (Mastitis) দেখা দিতে পারে ।
পাঠার পরিচর্যা
পাঠার পরিচর্যা সঠিক না হলে এর থেকে ভালোমানের বীর্য উৎপাদিত হবে না। ফলে সে পাঠা দিয়ে ছাগীকে প্রজনন করালে ভালোমানের বাচ্চা হবে না। কোনো পাঠার শারীরিক দুর্বলতা, পঙ্গুত্ব বা কোনো যৌন রোগ থাকলে সে পাঠা প্রজননের জন্য বাতিল করে দিতে হবে। পাঠাকে নির্ধারিত মাত্রায় সুষম খাবার ও বিশুদ্ধ পানি প্রদান করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সপ্তাহে অন্তত ২/৩ দিন ব্রাশ দিয়ে দেহ পরিষ্কার করে দিতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে যত্ন নিলে ও সুষম খাদ্য সরবরাহ করলে একটি পাঠা ১০-১২ বছর বয়স পর্যন্ত ভালোমানের বীর্য উৎপাদন করতে পারে।
আরও দেখুনঃ