আমাদের আজকের আর্টিকেলটি বাছুরের রোগব্যাধি দমন সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৪ এর অন্তর্ভুক্ত |
বাছুরের রোগব্যাধি দমন
চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি প্রবাদ আছে রোগব্যাধির চিকিৎসা অপেক্ষা প্রতিরোধই শ্রেয়। বাছুর উৎপাদনেও একই প্রবাদ প্রযোজ্য। বাছুর প্রতিপালনে দু’টো বিষয় উল্লেখ্যযোগ্য, যথা- ১. রোগব্যাধির প্রতি অপেক্ষাকৃত প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন বাছুর বাছাই করে প্রতিপালন করা ও ২. চিকিৎসার চেয়ে রোগব্যাধি দমনের প্রতি নজর দেয়া। বাছুরের রোগব্যাধি দমনের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে পালন করা উচিত। যথা-
- বাছুরের ঘরদোর, খাদ্য ও পানির পাত্র এবং অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এদের গোবর ও চনা সঠিকভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
- বিভিন্ন বয়সের বাছুরকে আলাদা আলাদা ঘরে বা খোপে (pen) পালন করতে হবে।
- সব সময় সুষম খাদ্য প্রদান করতে হবে। পঁচা বা বাসি খাবার সরবরাহ করা যাবে না ।
- কোনো বাছুরের মধ্যে অসুস্থতার লক্ষণ দেখামাত্র তাকে আলাদা করে ফেলতে হবে এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
- সংক্রামক রোগে মৃত বাছুরকে খামার থেকে দ রে মাটির নিচে গভীর গর্ত করে তাতে মাটিচাপা দিতে হবে এবং উপরিভাগে চুন বা ডি.ডি.টি. (D.D.T.) ছড়িয়ে শোধন করতে হবে।
- সব বয়সের বাছুরকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে ও সংক্রামক রোগপ্রতিরোধের জন্য টিকা প্রদান করতে হবে।
বাছুরে রোগব্যাধির প্রকোপ বড় গরুর তুলনায় বেশি। সেজন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবলম্বন করার পরও কোনো না কোনো রোগব্যাধিতে এরা আক্রান্ত হতে পারে। তাছাড়া কিছু রোগ আছে যা শুধু বাছুরেরই হয়ে থাকে। বাছুরের রোগপ্রতিরোধ ও চিকিৎসার ব্যাপারে স্থানীয় ভেটেরিনারি সার্জনের সাথে পরামর্শ করা যেতে পারে। এই পাঠে শুধু বাছুরে হয় এমন কিছু রোগব্যাধি আলোচনা করা হয়েছে।
সাধারণ স্কাউর (Common scour)
এটি বছরের অতি সাধারণ রোগ। জীবনের এক পর্যায়ে অধিকাংশ বাছুরই এই রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগটি তেমন মারাত্বক নয়। কিন্তু এতে যে ক্ষতিসাধিত হয় তা পরিমাপ করা অসম্ভব। এই রোগে বাছুরের জীবনীশক্তি কমে যায় এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তবে, যেসব বাছুর শালদুধ পান করে সেগুলোর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকায় এরা রোগের শিকার কম হয়।
কারণ :
কারণের মধ্যে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ প্রধান। তাছাড়া ঠান্ডা দুধ পান করানো, অপরিষ্কার পাত্রে খাদ্য পরিবেশন, কলুষিত তৈজসপত্রের (যেমন- বোতল, বালতি ইত্যাদি) ব্যবহার থেকে বদহজম সৃষ্টি ইত্যাদিও রোগের কারণ হতে পারে। তবে, সংক্রামক স্কাউরের (infectious scours) ক্ষেত্রে কতগুলো অশনাক্তকৃত জীবাণু সংশ্লিষ্ট থাকে। এই অবস্থায় রোগের মারাত্বক পরিণতিস্বরূপ ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে বাছুরের মৃত্যু ঘটে।
লক্ষণ :
রোগের প্রথম লক্ষণ অলসতা। ক্রমান্বয়ে চোখের নিরানন্দ ভাব, কানের পতন, বর্ধিত শ্বাসপ্রশ্বাস ও অনেক সময় অতিরিক্ত তাপমাত্রা দেখা যায়। সবশেষে পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে ।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ :
সংক্রামক রোগের বিস্তার যাতে না ঘটে সেজন্য পূর্ব থেকেই দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কেননা একবার স্কাউর হয়ে গেলে চিকিৎসা তেমন কার্যকরী হয় না। এই রোগ দমনের
গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নিম্নরূপ-
- যথাযথ স্বাস্থ্যসম্মত প্ৰতিপালন ।
- রোগাক্রান্ত বাছুরকে সুস্থগুলো থেকে আলাদা করা ও বাছুর প্রতিপালন প্রাঙ্গন সম্পূর্ণ পরিষ্কার- পরিন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখা।
- বাছুরকে শালদুধ পান করানো।
- যত্নসহকারে খাদ্য পরিবেশন করা।
- জন্মের পর বাছুরের নাভি টিঙ্কচার আয়োডিন (tincture iodine) বা ১০% সিলভার নাইট্রেট ( silver nitrate) দ্রবণে ধৌতকরণ এই রোগ দমনে খুবই কার্যকর।
তাছাড়া খাদ্য কমিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ শুরু করা যায়। ১২০-১৮০ মি.লি. রেড়ির তেল (castor oil) খাইয়ে আনুপাতিক হারে সালফাগুয়াডিনিন, সালফাখ্যালিডিন, সালফাডায়াজিন বা সালফামেরাজিন সেবন করালে উপকার পাওয়া যায়। পানিশ ন্যতা দেখা দিলে শিরার মাধ্যমে গুকোজ ইনজেকশন করলেও উপকার পাওয়া যায়।
ফুসফুস প্রদাহ (Pneumonia)
ফুসফুস প্রদাহ বা নিউমোনিয়া বাছুরের অতি সাধারণ রোগ। স্কাউর বা অন্য কোনো কারণে বাছুর যখন দুর্বল অবস্থায় পতিত হয় তখনই এই রোগে আক্রান্ত হয়। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই বাছুর মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে নিউমোনিয়া ।
কারণ :
বহু কারণে এই রোগ হতে পারে, যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী, ছত্রাক প্রভৃতির আক্রমণে। কাজেই এটি একটি জটিল রোগ। রোগের জীবাণু বা পরজীবীগুলো খাদ্য ও পানি, রোগাক্রান্ত বাছুরের স্পর্শ বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ছড়াতে পারে। স্যাঁতস্যাঁতে ও ভেজা অবস্থায় বাছুরকে রাখাও রোগের অতি সাধারণ কারণ।
লক্ষণ :
শরীরের তাপমাত্রা ৪০° সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয় এবং যত তীব্রতর হতে থাকে বাছুর তত অবসন্ন হয়ে পড়ে। কাশি হয়, নাক দিয়ে সর্দি ঝড়ে। নাকের চামড়া শুকিয়ে যায়, খাদ্য গ্রহণ কমে যায় ও সাধারণ অলসতাসহ বাছুর নিস্তেজ হয়ে পড়ে ও শুয়ে থাকতে পছন্দ করে ।
চিকিৎসা :
ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো উল্লেখিত যে কোনো একটি সালফোনেমাইড বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করালে সুফল পাওয়া যায়। তবে, একাধিক রোগজীবাণু জড়িত থাকায় সঠিক ওষুধ নির্বাচন করতে হবে। যেমন- সালফাডিমিডিন, পেনিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন, অ্যাম্পিসিলিন, টাইলুসিন প্রভৃতি ।
প্রতিরোধ :
বাছুরকে গরম ও শুকনো পরিবেশে রাখতে হবে। ছত্রাক আক্রমণ (Ringworm)
বাছুর খুব সহজে ছত্রাক দিয়ে আক্রান্ত হয়। এটা ছোঁয়াচে রোগ এবং এক পশু অন্য পশুর সংস্পর্শে এলে রোগের বিস্তার ঘটে। ছত্রাক চামড়ার উপরের স্তরে বাসা বাধে। শীতকালেই এরোগের আধিক্য, গ্রীষ্মকালে এটি অদৃশ্য হয়ে যায় ।
লক্ষণ :
আক্রান্ত বাছুরের শরীরের বিভিন্ন অংশের লোম ঝরে পড়ে। এতে চুলকানি হয় এবং বাছুরটি
সব সময় আক্রান্ত অংশ বেড়া বা খোপের দেয়ালে ঘষাঘষি করতে চায়।
চিকিৎসা :
আক্রান্ত বাছুরের ত্বকের ক্ষতস্থান ব্রাশের সাহায্যে পরিষ্কার করে সেখানে ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো উল্লেখিত যে কোনো একটি ওষুধ লাগাতে হবে। যথা- ১. টিঙ্কচার আয়োডিন ৭% ও স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ২% একত্রে মিশিয়ে একদিন পরপর মোট ১০ দিন। ২. হুইটফিল্ড মলম (Whitfield’s ointment) যা ৩% স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, ৫% বোরিক অ্যাসিড ও ভ্যাসেলিন সহযোগে ১০০ গ্রাম তৈরি করা হয়) প্রতিদিন একবার করে এক সপ্তাহ ।
প্রতিরোধ :
রোগপ্রতিরোধের জন্য সমস্ত বাছুরের খোপ ও আবাসস্থল বিশোধন দ্রব্য দিয়ে শোধন করতে হবে । আক্রান্ত পশুকে অন্যগুলো থেকে আলাদা রাখতে হয় ।
বাদলা রোগ (Black Quarter)
বাছুরের বয়স ৬ মাস হলে বাদলা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বাদলা একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত (bacteria) রোগ। বর্ষাকালে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে এই রোগ সংক্রামিত হয়।
লক্ষণ:
রোগ অতি তীব্র আকারে হলে কোনো লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই বাছুর মারা যায়। মৃত্যু এত আকস্মিক না হলে ক্ষুধামান্দ্য, জ্বর ( ৪০০-৪১৭° সে.), পেটে গ্যাস জমা, মুখবন্ধনি শুকিয়ে যাওয়া, নাকে পেষ্মা, অবসাদভাব ইত্যাদি দেখা যায়। লক্ষণ প্রাকাশের ১২-৩৬ ঘন্টার মধ্যে বাছুর মারা যায়।
রোগ ততোটা তীব্র আকারে দেখা না দিলে উপরের লক্ষণগুলোর সঙ্গে পায়ের মাংসপেশি আক্রান্ত হয়। মাংসপেশি গরম হয় ও ফুলে যায়। এতে প্রচন্ড ব্যাথা হয়। ফলে হাঁটতে গেলে পশু খোড়ায় । আক্রান্ত মাংসপেশি টিপলে পচ্ পচ্ ভজ ভজ শব্দ হয়। এই অবস্থায় ১২-৭২ ঘন্টার মধ্যে বাছুর মারা যায়।
চিকিৎসা:
লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে অ্যান্টিবায়োটিক বা সালফোনোইডজাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা না করালে পরে ওষুধে কাজ হবে না। পেনিসিলিন বা টেট্রাসাইক্লিনজাতীয় ওষুধ ভেটেরিনারি সার্জনের পরমর্শমতো প্রয়োগ করতে হবে।
প্রতিরোধ
প্রতিরোধের জন্য ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো সময়ে বাছুরকে বাদলা রোগের টিকা প্রদান করতে হবে।
কৃমি রোগ (Worm infestation)
বাছুর প্রধানত গোলকৃমি দিয়েই বেশি আক্রান্ত হয়। তবে ফিতা বা পাতাকৃমি দিয়েও আক্রান্ত হতে পারে ।
লক্ষণ :
আক্রান্ত বাছুরের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়, বুকের হাড়গুলো ভেসে ওঠে। পেট ফুলে ওঠে ও বাছুর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে যায় ও কমনীয়তা নষ্ট হয়। মলের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কৃমি বা কৃমির অংশ বের হয়ে আসে। ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়। প্রায়ই পাতলা পায়খানা করে ও পায়খানায় গন্ধ থাকে। পরিশেষে বাছুর রক্তশূন্য হয়ে পড়ে, নিস্তেজ ও ফ্যাকাশে দেখায়, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, চোয়াল বা দেহের বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে ও পিপাসা বৃদ্ধি পায়।
চিকিৎসা :
ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো গবাদিপশুর কৃমি নিবারণের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধ, যেমন- মেবেন্ডাজল, ক্যামবোজল, থায়োফিনেট প্রভৃতি সঠিক মাত্রায় সেবনের মাধ্যমে সহজেই এই রোগ নিরাময় করা যায়।
প্রতিরোধ :
কৃমি প্রতিরোধের জন্য ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো বাছুরকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে।
আঁচিল (Warts)
বাছুরের দেহের নানা স্থানে আঁচিল উঠতে পারে, বিশেষ করে চোখ, গলা বা ঘাড়ে। এগুলো তেমন কোনো ক্ষতি করে না। এগুলো ভাইরাসের কারণে হয়। শল্যচিকিৎসা বা অপারেশনের মাধ্যমে এগুলো অপসারন করা যায়।
আরও দেখুনঃ