ভেড়া পালনে সুবিধাদি, ভেড়ার বাসস্থান ও পরিচর্যা

আমাদের আজকের আর্টিকেলটি ভেড়া পালনে সুবিধাদি, ভেড়ার বাসস্থান ও পরিচর্যা সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৭ এর অন্তর্ভুক্ত |

ভেড়া পালনে সুবিধাদি, ভেড়ার বাসস্থান ও পরিচর্যা

 

ভেড়া পালনে সুবিধাদি, ভেড়ার বাসস্থান ও পরিচর্যা

 

ভেড়া পালনে সুবিধাদি

ভেড়া পালনের বেশ সুবিধা রয়েছে। এগুলো নিম্নরূপ-

  • ভেড়া তুলনামূলকভাবে দামে সস্তা ও দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম। প্রতি বিয়ানে একেকটি ভেড়া ৩-৪টি বাচ্চার জন্ম দিয়ে থাকে। এরা ছাগলের মতো ১৫ মাসে দু’বার বাচ্চা দেয়। তবে, এদের পরিপক্কতা কিছুটা দেরিতে আসে।
  • এরা শুধু ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এদের জন্য তেমন কোনো সম্পরক খাদ্য লাগে না । আগাছাপূর্ণ ভূমি পরিষ্কার করতে এদের জুড়ি নেই। এরা প্রয়োজনে যে কোনো ধরনের খাবার খেতে পারে। আগাছা, ঘাস, লতাগুল্ম, মূল, কন্দ, শস্যদানা, পাতা, ছাল, এমনকী খাদ্য ঘাটতির সময় প্রয়োজন হলে মাছ বা মাংসও খেতে সক্ষম।
  • এরা ঘাস খেয়ে তা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উল ও মাংসে রূপান্তরিত করতে পারে।
  • ভেড়া সব সময় দলনেতাকে অনুসরণ করে, তাই এদের লালনপালন ও ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত সহজ।
  • এদের জন্য তেমন কোনো উন্নতমানের বাসস্থানের প্রয়োজন হয় না।
  • ভেড়ার মাংস ও দুধ বেশ সুস্বাদু। এদের চামড়া বিক্রি করেও ভালো অর্থ আয় করা যায়।
  • ভেড়ার লোম বা পশমই উল (wool) নামে পরিচিত। এগুলো অত্যন্ত দামি। উল থেকে শীতবস্ত্র, কম্বল, শাল ইত্যাদি তৈরি হয়।
  • ভেড়ার গোবর ও চনা উৎকৃষ্টমানের জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
  • ভেড়ার হাড়ের গুঁড়ো গবাদিপশু ও পোল্ট্রির খাদ্য এবং উৎকৃষ্ট সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর নাড়িভুঁড়ি ও রক্তে রয়েছে উন্নতমানের আমিষ যা হাঁসমুরগির খাদ্য বা পোল্ট্রি ফিড হিসেবে বেশ জনপ্রিয়।
  • ভেড়া অত্যন্ত অর্থকরী প্রাণী।

ভেড়ার এতো গুণাগুণ থাকলেও বাংলাদেশে এরা তেমন একটা জনপ্রিয় নয়। সংখ্যাও খুব অল্প। এদেশের ভেড়ার কোনো ভালো জাত নেই। ভেড়া শুষ্ক ও শীতল আবহাওয়ার প্রাণী। এদেশের ভেজা ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া এদের জন্য উপযোগী নয়। বাংলাদেশে নোয়াখালী ও বরিশালের উপকূলীয় অঞ্চলেই বেশি সংখ্যায় ভেড়া পালন করা হয়। আমাদের দেশের স্থানীয় জাতের ভেড়ার লোম সাদা হলেও অযত্নের কারণে তা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এদের পশম অত্যন্ত মোটা ও নিমানের। ফলে এথেকে ভালো উল প্রস্তুত হয় না।

এই উল থেকে কম্বল ছাড়া অন্য কিছু তৈরি করা সম্ভব নয়। বাস্তবে, এদেশে ভেড়া থেকে মাংস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না বললেই চলে। ভেড়ার মাংসও বেশিরভাগ লোকই পছন্দ করেন না। তবে, এদেশের ভেড়ার প্রতি কিছুটা নজর দিলে সহজেই এথেকে আত্বকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে। বিদেশী উন্নত জাতের ভেড়ার সঙ্গে প্রজনন ঘটিয়ে সংকরজাত সৃষ্টি করলে তা থেকে উন্নতমানের উলও পাওয়া যাবে। ফলে ভেড়া পালন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়ে ওঠবে।

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

ভেড়ার বাসস্থান

ওপর নির্ভরশীল।এদেরকে ঘাসপূর্ণ বিস্তীর্ণ মাঠে পালন করা হয় যেখানে এরা দল বেধে ঘাস খেতে ভেড়ার জন্য বাসস্থান তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ এরা প্রধানত মাঠে চরে ঘাস খাওয়ার খেতে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে থাকে।রাতের বেলা মাঠেই একসঙ্গে বিশ্রাম নেয়। তবে, শীতপ্রধান দেশে শীতকালে এদের জন্য বাসস্থানের দরকার পড়ে। তাছাড়া আরও কয়েকটি কারণে ভেড়ার বাসস্থানের প্রয়োজন পড়ে। যেমন-

  • রাতের বেলা ভালোভাবে বিশ্রাম নেয়ার জন্য।
  • শিকারি প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
  • যেসব ভেড়া বেশি দুধ দেয় তাদের দুধ দোহনের জন্য।
  • গর্ভবর্তী, প্রসূতি ও বাচ্চা ভেড়ার সঠিক পরিচর্যা করার জন্য। চোরের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ।
  • আমাদের মতো স্যাঁতস্যাঁতে দেশে ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ।

ভেড়ার ঘরের ধরন

ভেড়া পালনের জন্য প্রধানত তিন ধরনের ঘর ব্যবহার করা হয়। যেমন- ক. খোলা বা উন্মুক্ত ঘর, খ- আধা-উন্মুক্ত ঘর ও গ. আবদ্ধ বা ছাদযুক্ত ঘর ।

ক. উন্মুক্ত ঘর :

যেসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অত্যন্ত কম হয় সেখানে উন্মুক্ত ঘরে ভেড়া পালন করা হয়। নির্দিষ্ট জায়গার চারদিকে বেড়া দিয়ে এই ধরনের ঘর তৈরি করা হয়। এতে কোনো ছাদ থাকে না । মেঝেতে প্রধানত খড় ব্যবহার করা হয়।

খ. আধা-উন্মুক্ত ঘর :

চারদিক ঘিরে বেড়া দেয়া একটি নির্দিষ্ট স্থানের এক কোণে খানিকটা জায়গা ছাদ দিয়ে ঘিরে এই ধরনের ঘর তৈরি করা হয়।

গ. আবদ্ধ ঘর :

এই ধরনের ঘরের পুরো অংশই ছাদ দিয়ে ঘেরা থাকে। ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকে। মেঝে পাকা বা আধাপাকা হতে পারে। আমাদের মতো দেশে ভেড়া পালনের জন্য এ ধরনের ঘরই উপযোগী। ভেড়া সারাদিন মাঠে চরবে ও রাতের বেলা ঘরে আশ্রয় নেবে। তাছাড়া ঝড়বৃষ্টি বা খারাপ আবহাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই ধরনের ঘর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ।

ভেড়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা

ভেড়ার জন্য ভূমিসমতল মেঝে (খড়ের তৈরি) বা মাঁচার মেঝে তৈরি করা যায়। মাঁচার মেঝেতে জীবাণু ও কৃমি সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে। তাছাড়া এটি স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। মাঁচার তৈরি মেঝেতে ভেড়ার জন্য তুলনাম লকভাবে জায়গাও কম লাগে। সারণি ৩৪-এ বিভিন্ন বয়সের ভেড়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।

সারণি ৩৪ : মাঁচার মেঝে ও খড়ের মেঝেতে বিভিন্ন বয়সের ভেড়ার জন্য বরাদ্দকৃত স্থান

 

ভেড়া পালনে সুবিধাদি, ভেড়ার বাসস্থান ও পরিচর্যা

 

ভেড়া পালনে সুবিধাদি, ভেড়ার বাসস্থান ও পরিচর্যা

 

ভেড়ার পরিচর্যা

ভেড়াকে সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম রাখা এবং এর থেকে পর্যাপ্ত উৎপাদন পেতে হলে সঠিকভাবে যত্ন বা পরিচর্যা করতে হবে। গরু, মহিষ বা ছাগলের মতোই দৈনিক ভেড়ার পরিচর্যা করতে হবে। বিভিন্ন বয়সের ভেড়াকে প্রয়োজনমাফিক সেবাযত্ন করতে হবে। তাছাড়া গর্ভবর্তী, প্রসূতি, নবজাতক প্রভৃতি ভেড়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে যত্ন নিতে হবে। নিম্নলিখিতভাবে ভেড়ার পরিচর্যা করা যায়। যথা—

  • প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের করে মাঠে চরার জন্য ছেড়ে দিতে হবে। তারা যেন পর্যাপ্ত সময় মাঠে চরতে পাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • ঘর ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। গোবর বা চনা যেন কোনো রোগের কারণ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একবার জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে ঘর জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
  • এদের চিহ্নিত করার জন্য অবশ্যই কানে ট্যাগ নম্বর লাগাতে হবে ।
  • সাধারণত বিশেষ অবস্থা ছাড়া এদেরকে তেমন কোনো দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হয় না । তবে, গর্ভবতী, প্রসূতি, বাচ্চা ভেড়া ও প্রজননের পাঠার জন্য সম্পূরক (supplementary) খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • নিয়মিত ব্রাশ দিয়ে দেহ পরিষ্কার করতে হবে। এতে উলের ভেতরের ময়লা বেরিয়ে আসবে ও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে। নিয়মিত ব্রাশ করলে উল উজ্জ্বল দেখাবে ও চামড়ার মান বৃদ্ধি পাবে ।
  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ভেড়ীর দুধ দোহন করতে হবে। দুধ দোহনের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
  • ভেড়ার উল কাটার পূর্বে এদেরকে বহিঃপরজীবীনাশক ওষুধ দিয়ে গোসল বা ধৌত করাতে হবে অথবা এদের দেহে তা ছিটিয়ে দিতে হবে। এই সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেন ভেড়া সে বিষাক্ত ওষুধ খেয়ে না ফেলে। এভাবে বহিঃপরজীবীনাশক ব্যবহার করলে বিভিন্ন ধরনের উকুন, আটালি ও অন্যান্য বহিঃপরজীবী ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি উল থেকে বিভিন্ন ময়লা দূর হয়, মাছির কীড়া দেহে বাসা বাঁধতে পারে না। এতে উলের মানও বৃদ্ধি পায় ।
  • নির্দিষ্ট মৌসুমে ভেড়ার দেহ থেকে উল কেটে নিতে হবে। প্রজননের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ভেড়াকে একাজে ব্যবহারের পূর্ব উল কেটে দিলে প্রজনন ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ে।
  • প্রজননের কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্য না থাকলে পুরুষ বাচ্চা ভেড়াকে সময়মতো খাঁসি করে নিতে হবে ।
  • অসুস্থ ভেড়াকে অন্যান্য সুস্থ ভেড়া থেকে পৃথক করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • সকল বয়সের ভেড়াকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে ও টিকা প্রদান করতে হবে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment