আমাদের আজকের আর্টিকেলটি ছাগল পালনে বিভিন্ন সুবিধাদি সম্পর্কে – যা বাউবি বিএজএড ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন ইউনিট – ৬ এর অন্তর্ভুক্ত |
ছাগল পালনে বিভিন্ন সুবিধাদি
ছাগল পালনে সুবিধাদি
- ছাগল দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। এরা ৬/৭ মাস বয়সেই প্রজননের (breeding) উপযোগী হয়। ছাগী গর্ভবতী হওয়ার প্রায় পাঁচ মাস পরেই বাচ্চা প্রসব করে এবং প্রতিবারে অন্তত ২/৩টি বাচ্চা দেয় । কাজেই একটি ছাগী থেকে বছরে অন্তত চারটি বাচ্চা পাওয়া যায় ।
- ছাগল ছোট প্রাণী; তাই এদের জন্য জায়গা কম লাগে। এরা নিরীহ বলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও পালন করতে পারে। ছাগল পালনে পুঁজি কম লাগে। এটি ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস ।
- যে পরিবেশ বা আবহাওয়ায় গরু মহিষ জীবনধারণ করতে পারে না ছাগল সেখানে সহজেই খাপ খাইয়ে নেয় ।
- গরু মহিষের তুলনায় এদের জন্য খাদ্য কম লাগে। কারণ, ছাগল খাদ্য রূপান্তরে (feed conversion) গরুর থেকে বেশি দক্ষ। এরা বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা, ঘাস, লতা খেয়ে সহজেই জীবনধারণ করতে পারে।
- গরুর তুলনায় ছাগল রোগব্যাধিতে কম আক্রান্ত হয়।
- ছাগলের দুধের চর্বির কণিকাগুলো (fat globules) অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ায় গরুর দুধের তুলনায় সহজে হজম হয়। তাই বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য এই দুধ অধিক উপযোগী, উপাদেয় এবং উৎকৃষ্ট।
- ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। এগুলো মোলায়েম ও নরম আঁশযুক্ত, তাই সহজে হজম হয়। খাসির মাংস সকল ধর্মের লোকের কাছেই অত্যন্ত প্রিয়। এদেশে ছাগলের মাংসের
- দাম তুলনাম লকভাবে বেশি বলে বাণিজ্যিকভাবে অধিক লাভজনক। বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়ার গুণগতমান অতি উন্নত, তাই বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক চাহিদা। এই চামড়া রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে ।
ছাগলের দুধ (Goat milk)
এদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল অত্যন্ত অল্প পরিমাণ অর্থাৎ ২৫০-৫০০ মি.লি. দুধ দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, যমুনাপারি ছাগল তুলনামূলকভাবে বেশি দুধ দেয়। তবে, অল্প হলেও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের
দুধ অত্যন্ত পুষ্টিকর। গুণগতমানে এই দুধ মানুষ বা গরুর দুধের থেকেও সেরা (সারণি ২৫ দেখুন)। গরুর দুধের তুলনায় এই দুধ সহজে হজম হয়। দুধের চর্বির কণিকা ক্ষুদ্র ও সহজপাচ্য। তাই এই দুধ রোগীদের জন্য পথ্য ও শিশুদের জন্য উপযুক্ত খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। শিশুদের জন্য মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে ছাগলের দুধ গরুর দুধের থেকে বেশি উপযোগী।
কারণ, এতে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। এটি অ্যালার্জিক পদার্থমুক্ত এবং বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে ভরপুর । এই দুধে ভিটামিন-এ, নিকোটিনিক অ্যাসিড, কোলিন, ইনসিটল ইত্যাদি বেশি পরিমাণে এবং ভিটামিন-বি ও ভিটামিন-সি অল্প পরিমাণে রয়েছে। দুধ একটি আদর্শ খাদ্য হলেও গরুমহিষের দুধে ভিটামিন-সি-এর অভাব থাকায় একে মানুষের জন্য একটি সম্পূর্ণ খাদ্য বলা যায় না। ছাগলের দুধে মানুষ ও গরুর দুধের তুলনায় ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ক্লোরিন বেশি এবং লোহা কম থাকে।
এছাড়াও এ দুধে যথেষ্ট পরিমাণে সোডিয়াম, কপার বা তামা ও অন্যান্য খনিজপদার্থ থাকে। কিন্তু এত গুণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে অনেকেই ছাগলের দুধ পছন্দ করেন না। ছাগলের দুধ পানে অনভ্যস্ততা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সহজলভ্য না হওয়াকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ।
সারণি ২৫ : ছাগী, গাভী ও স্পীলোকের দুধে উপস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের তুলনা
ছাগলের মাংস (Goat meat )
ছাগলের মাংস এদেশে খাসির মাংস নামেই বেশি পরিচিত। ইংরেজিতে ছাগলের মাংস চেভন নামে পরিচিত। খাসির মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর প্রাণিজ আমিষজাতীয় খাদ্য। এ মাংস দেখতে অনেকটা কালচে বা গাঢ় লাল (dark red) এবং এতে চর্বি পাতলাভাবে সন্নিবেশিত থাকে। উন্নত বিশ্বে ছাগলের মাংস তেমন জনপ্রিয় নয়। সেখানে এই মাংস গরীবের মাংস হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই দামে বেশ সস্তা। কিন্তু, বাংলাদেশসহ পাক-ভারত উপমহাদেশে ছাগলের মাংসের অত্যন্ত চাহিদা।
গরুর মাংস খেলে যাদের অ্যালার্জি হয় তারা খাসির মাংসের ওপরই বেশি নির্ভর করেন। ছাগলের মাংস বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদানে ভরপুর (সারণি ২৬ দেখুন)। ৬-১২ মাস বয়সের ছাগলের মাংস উৎকৃষ্ট। এই বয়সের ছাগল থেকে ৪৩-৫৩% মাংস পাওয়া যায়।
পাঠার মাংসে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গন্ধ থাকে বলে অনেকেই তা পছন্দ করেন না। বাচ্চা ছাগলের মাংস কিছুটা আঠালো, নরম ও বিশেষ ঘ্রাণযুক্ত হয়। এই মাংস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা যায়। তবে, এদেশের লোকেরা সাধারণত ১৮-২৪ মাস বয়সের চর্বিযুক্ত খাসির মাংস বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু, যাদের হজমশক্তি দুর্বল ও যারা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন তাদের জন্য চর্বিযুক্ত মাংস ক্ষতিকর।
উৎকৃষ্ট মাংসের বৈশিষ্ট্য
- উৎকৃষ্ট মাংসের মধ্যে রক্তের শিরা-উপশিরাগুলো রক্তশ ন্য থাকবে।
- মাংসের রঙ কালচে বা গাঢ় লাল হবে ।
- চর্বি অত্যন্ত তাজা হবে যা ভেড়ার মাংসের ন্যায় আঁশের ভাঁজে ভাঁজে থাকবে না। বরং মাংসের উপরে একটা পাতলা আবরণের মতো থাকবে। চর্বি সাদা থেকে হলুদ বর্ণের হতে পারে।
- মাংসের মধ্যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক গন্ধ থাকবে না ।
- মাংস তাজা ও উজ্জ্বল হবে।
সারণি ২৬ : ছাগলের মাংসে উপস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ
ছাগলের চামড়া (Goat skin )
ছাগলের চামড়া অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এই চামড়াতে সারবস্তু ও দানাদার অংশ ভেড়ার চামড়ার তুলানায় বেশি থাকে । ছাগলের লোম ভেড়ার পশমের মতো পেঁচানো বা কোঁকড়ানো নয় এবং এদের গোড়া ভেড়ার মতো চামড়ার বেশি গভীরে প্রবেশ করে না। ফলে চামড়া পাকা করার পর লোমের গোড়া শোষক বা স্পঞ্জি (spongy) হিসেবে চামড়ার মধ্যে থেকে যায় না। তাই চামড়ার মান হয় অতি উন্নত। ছোট, রেশমি ও সুন্দর লোমে আবৃত চামড়া বড়, লম্বা ও রুক্ষ লোমে আবৃত চামড়া থেকে বেশি উন্নতমানের হয়।
সাধারণত মাংস উৎপাদনের জন্য পালিত ছাগল থেকে ভালোমানের চামড়া পাওয়া যায়। অধিক চর্বিযুক্ত ও মোটাসোটা ছাগলের তুলনায় কম চর্বিযুক্ত ছিপছিপে ছাগলের চামড়া উৎকৃষ্ট। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে একটি ছাগলের চামড়ার মূল্য প্রাণীটির মূল্যের ৫-১০% হয়ে থাকে । তাই চামড়া ছাড়ানোর সময় যত্নবান হতে হবে যেন তা কেটে না যায়। জাতভেদে একটি পূর্ণবয়স্ক ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার পর ০.৭৫-২.০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সাধারণত ৯-১৮ মাস বয়সের ছাগলের চামড়া থেকে ভালোমানের জুতো, ব্যাগ, সুটকেস, পরিধেয় বস্তু, জ্যাকেট, তাবু ইত্যাদি তৈরি হয়। কিন্তু দস্তানা তৈরি, বই বাঁধানো প্রভৃতি কাজের জন্য ৬ মাস বয়সের ছাগলের চামড়া ভালো। বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের গায়ের লোম ছোট, মসৃণ ও নরম। তাই চামড়া নরম, পুরু ও উন্নতমানের।
চামড়ার তন্তু (fibre) অত্যন্ত ঘনভাবে সন্নিবেশিত থাকে এবং চামড়া অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক (elastic) হয়। এই চামড়া যে কোনো আবহাওয়ায় বেশি দিন টিকে। আর্দ্র জলবায়ু এবং পানিতেও সহজে নষ্ট হয় না। এসব কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়ার চাহিদা বিশ্ববাজারে অত্যন্ত বেশি। তবে, চামড়ার সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা উন্নত করতে পারলে চাহিদা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে ।
ছাগলের লোম/পশম (Hair / fleece )
বিভিন্ন জাতের ছাগল থেকে বিভিন্ন ধরনের লোম (hair) উৎপন্ন হয়। কোনো কোনো জাতের ছাগল, যেমন- অ্যাংগোরা ও কাশ্মিরির পশম (fleece or wool) থেকে ভেড়ার উলের থেকেও উন্নতমানের উল উৎপন্ন হয়। এগুলো যথাক্রমে মোহেয়ার (mohair) ও পশমিনা (pashmina) নামে পরিচিত। লোম ও পশম কিন্তু এক জিনিস নয়। সাধারণত ভেড়ার লোমকেই উল বলে (ব্যতিক্রম- অ্যাংগোরা ও কাশ্মিরি ছাগলের উল)। পশমের পৃষ্ঠতল খাঁজকাটা; এগুলো কোঁকড়ানো বা ঢেউ খেলানো ও অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক। পশমের অভ্যন্তর ভাগে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ রয়েছে। পক্ষান্তরে লোমের পৃষ্ঠতল মসৃণ এগুলো কোঁকড়ানো নয় এবং স্থিতিস্থাপকও নয়।
জাতভেদে ছাগলের লোম/পশম খাটো বা লম্বা এবং নানা বর্ণের হতে পারে। এসব লোম/পশম থেকে কার্পেট, কম্বল, মূল্যবান শীতের পোষাক, বিখ্যাত কাশ্মিরি শাল, এমনকি, রশিও তৈরি করা হয়। এদেশে ছাগলের লোম কোনো কাজেই ব্যবহার করা হয় না। অথচ এগুলো বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ছাগলের লোম/পশম রপ্তানির ক্ষেত্রে পাকিস্তান শীর্ষস্থানীয় ।
মোহেয়ার
তুরস্কের অ্যাংগোরা জাতের ছাগল থেকে প্রাপ্ত সাদা, নরম, উজ্জ্বল ও উন্নত গুণসম্পন্ন সুতোর মতো পশমই মোহেয়ার নামে পরিচিত। এগুলো ১০-২৫ সে.মি. লম্বা হয়। দামি চাদর ও কম্বল তৈরিতে মোহেয়ার ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি ছাগল থেকে বছরে ২.৫-৪.৫ কেজি মোহেয়ার পাওয়া যায়।
পশমিনা
কাশ্মিরি ছাগলের লোমকে পশমিনা বলা হয়। পশমিনা মোটা ও রঙিন হতে পারে। এগুলো দেখতে উলের মতোই। তবে আকারে লম্বা, গড়ে ২.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। প্রতিটি ছাগল থেকে বছরে গড়ে ১০০-১২০ গ্রাম পশমিনা উৎপন্ন হয়। উৎপাদন কম বলে দাম অনেক বেশি। পশমিনা সূক্ষ্মতা বা মিহিত্বের (fineness) জন্য বিখ্যাত ।
হাড় ও নাড়িভুঁড়ি (Bones and offals)
ছাগলের দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রাপ্ত হাড় গুঁড়ো করার পর তা প্রক্রিয়াজাত করে হাঁসমুরগি ও গবাদিপশুকে খাওয়ানো যেতে পারে। হাড়ের গুঁড়ো উৎকৃষ্টমানের সার হিসেবেও জমিতে ব্যবহার করা যায়। হাড়ের গুঁড়ো, নাড়িভুঁড়ি ও মানুষের খাবার অনুপযোগী মাংস দিয়ে হাঁসমুরগি, কুকুরবিড়াল প্রভৃতির খাদ্য তৈরি করা যায়। তবে, পশুপাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার পূর্বে এগুলোকে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
রক্ত (Blood)
রক্তে রয়েছে উন্নতমানের আমিষ ও খণিজদ্রব্য। রক্ত থেকে তৈরি ‘ব্লাড মিল (blood meal ) ‘গবাদিপশু, হাঁস, মুরগি ও কোয়েলের খাদ্যতালিকা বা রেশন (ration) তৈরিতে সহজেই ব্যবহার করা যায়। তবে, খাদ্যতালিকায় ব্লাড মিলের পরিমাণ ২-৩%-এর বেশি থাকা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে যে, রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সঠিকভাবে না হলে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। ফলে এই
খাদ্য খেয়ে পশুপাখি রোগাক্রান্ত ও হতে পারে।
মলমূত্র (Urine and feces)
ছাগলের মলমূত্র বা গোবর ও চনা মূল্যবান জৈব সার। এগুলো জমির উর্বরতা বাড়ায়। কারণ, এতে পটাশ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস উল্লেখযোগ্য পরিমাণে থাকে। সবুজ সার হিসেবে গোবর ও চনা বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
আরও দেখুনঃ